হা অভিমানিনী নারী
হা অভিমানিনী নারী,
এমন একটা নিস্তব্ধ প্রলয় হবে কে জানত। এই সে দিনও বলেছিলি, “শ্যুটিং শেষ, তবে শরীরটা কেমন যেন হয়ে আছে। কিন্তু তোমার সঙ্গে বসতে হবে, হাজার প্রশ্ন জমে আছে।”
আর বসা হল না। কোন নতুন সিন্ধুপারে চলে গেলি তুই।
আমি জানি অতি সৃষ্টিশীল মানুষ যদি নিসর্গ মধুর ভালমানুষ হন, তবে তাঁর মধ্যে একটা বহুবল্লভতার ‘বিশেষ’ থাকে। অন্য অনেক মানুষই তখন সেখানে বড় ব্যক্তিগত হয়ে পড়েন। ভাবেন—এ মানুষটা আমাকেই খুব বেশি ভালবাসত। আমাকেই বেশি মূল্য দিত। আমারই কথা বুঝি শুনত সব চেয়ে বেশি। এই লেখার সময় আমার এই যে ব্যক্তিগত অনুভূতি, এই অনুভূতি আরও অনেকের আছে এবং সেটা একটা বড় সত্য প্রমাণ করে। অর্থাৎ এক জন খ্যাতিমান ফিল্মমেকার, নিশ্চিত ভাবে প্রখর বুদ্ধিমান হওয়া সত্ত্বেও, এমন একটা মধুর ‘মানুষ’ ছিল ওর মধ্যে, যার সঙ্গে সমাজের, তার সঙ্গে অনন্ত অভাজনেরও প্রিয়ত্বের সম্বন্ধ ঘটে গিয়েছে তাড়াতাড়ি। এর জন্য যে সব সময় ওর সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে তাও নয়। অনেক সময় ওর ফিল্মের কথা সেই বল্লভতা দিয়েছে মানুষের কাছে।
আমার সঙ্গে যে দিন ওর টেলিফোনে কথা হয়েছিল সে দিনই বুঝি প্রথম এবং শেষ বার একবারমাত্র ওর মুখে ‘আপনি’ কথাটা শুনেছিলাম। প্রথম দেখা করার প্রস্তাবটার মধ্যে এমন একটা আন্তরিকতা ছিল, এমনই বিশাল এক প্রতিষ্ঠিত অভিমানমঞ্চ থেকে নেমে আসা ছিল, যেটা বোধহয় একজন ছাত্রও করে না। ঋতু বলেছিল— আমি মহাভারত পড়তে চাই তোমার কাছে, তুমি পড়াও আমাকে। ঋতুর অবশ্য আর এক দোসর ছিল, দেবজ্যোতি মিশ্র। সেও জুটেছিল ঋতুর সঙ্গে। আমি প্রথমে একটু থতমত খাই। কিন্তু সেটা বুঝেই ও আমাকে শুধরে দেয়তোমার ভয় নেই, ভাল ছাত্র পাবে। হয় তুমি এসো আমার বাড়িতে, নয় আমি যাব তোমার বাড়ি। বলেছিলাম আমিই যাব। নির্দিষ্ট দিনে ও কিন্তু কাচ তোলা গাড়িটি নিয়ে আমার বাড়িতে এসেছিল আমাকে নিতে।
এটা ঠিকই যে, ঋতুর সঙ্গে মহাভারত পড়া মানে এই নয় যে, মহাভারতের প্রতি পঙক্তি ধরে আমি মহাভারত বোঝাচ্ছি। আর সে যেটা শুনছে ‘ভাগবৎ’ পাঠের মতো। বস্তুত আমি যখন ওর সঙ্গে মহাভারত কথায় পৌঁছে গিয়েছি তখনও বুঝেছি—আমার ছাত্র একেবারে তৈরি ছাত্র। ঋতু অনেক আগেই খুব ভালভাবে মহাভারত পড়ে ফেলেছিল। এবং সে পড়াটা এতটাই খুঁটিনাটিসহ, যে পেটের ভেতর খাদ্য জীর্ণ করার জন্য ‘মিথিক্যাল’ আগুনের নামটা নিয়ে ‘কনফিউশন’ হতেই বাড়ির ভেতর থেকে হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশের কয়েক খণ্ড এনে ফেলেছিল আমার সামনে। বলেছিল বার করো না সেই জায়গাটা—আমি ভুলে গিয়েছি। আমি বলেছিলাম—আমিও ভুলে গিয়েছি। পরে এক সময়ে সেই জায়গাটা যখন সঠিক ভাবে পেয়েছিলাম, তখন দেখেছি—তথ্যটা কিন্তু ওর আনা সেই হরিদাসী খণ্ডগুলোর মধ্যে ছিল।
হয়তো এটা নিছকই একটা প্রাসঙ্গিক তথ্য সংশোধনের জন্য একেবারেই সাময়িক এক উত্তেজনা। কিন্তু আমার সঙ্গে ওর মহাভারত আলোচনার প্রসঙ্গ ছিল অন্তত বিষয়-ভিত্তিক আদানপ্রদান। সে আলোচনায় দ্রৌপদীর চুল থেকে জর্জরিত রণক্ষেত্রে দাঁড়ানো গান্ধারীর বিচরণভঙ্গি, সব কিছু এসে পড়ত। আসলে মহাভারত পড়ার চাইতে ঋতু মহাভারতের ছবি দেখতে পেত অনেক বেশি। ফলে অস্ত্রশিক্ষার কালে অর্জুনের দৃপ্ত ভঙ্গি কর্ণের প্রবেশে কী ভাবে আহত প্রতিহত হচ্ছে—এই আলোচনায় মহাভারতের কবির শব্দ সরস্বতী কখন যে আমাদের রবীন্দ্রনাথের ‘কর্ণ কুন্তী সংবাদ’য়ে পৌঁছে দিয়েছে এবং সেখানে ঋতুর কথাক্ষেপ কী ভাবে সম্পূর্ণ বৃত্তটাকে কেমন করে একটা ছবিতে পরিণত করে দিয়েছে—সেই মত্ততা নিয়ে বাড়ি ফিরতাম আমি।
আসলে ঋতুর মহাভারত পড়াটা ছিল মহাভারতের শৈলীর মতোই। এবং সেগুলিকে ঋতুপর্ণ-নৃসিংহ-সংবাদ বললে কিছু মাত্র অত্যুক্তি হবে না। কেননা ঋতু এটা বুঝেছিল যে আমরা একবিংশ শতাব্দীতে বসে মহাভারত পড়ছি। ফলত এই মহাভারত পড়তে গেলে এথনোলজি, অ্যানথ্রোপলজি, ইতিহাস, ভূগোল সব লাগে।
আমার মনে আছে ঋতু প্রশ্ন করা আরম্ভ করত, এবং সে প্রশ্ন কখনওই এমন নয় যে পাশা খেলায় হেরে যাওয়ার পর যুধিষ্ঠির কী ভাবে রাজসভায় বসেছিলেন সেটা বলো। ঋতুর প্রশ্ন ছিল— স্বর্গে ইন্দ্রের রাজসভায় ইন্দ্র আর অর্জুন একসঙ্গে উর্বশীর নাচ দেখছেন। নাচ দেখার পর, বাবা ইন্দ্র উর্বশীকে প্ররোচিত করছেন ছেলের কাছে যাবার জন্য—‘তুমি এটাকে কী ভাবে দেখছ? এখানে আমি যখন উত্তর দিতে থাকব, ঋতু সেখানে ‘ইন্টার্যাপ্ট’ করবে, ‘ইন্টারফিয়ার’ করবে। এবং প্রসঙ্গান্তরে তর্ক জুড়ে দেবে। তার পরে মহাভারতের অন্য একটা প্রসঙ্গে এসে পড়বে, ঋতু আবারও প্রতিযুক্তি তুলবে এবং অবশেষে এমন কাব্যময় পরিস্থতিও তৈরি হয়ে যেতে পারত, যাতে চা দিতে আসা ঋতুর সেই বিশ্বস্ত মানুষটি ভাবত নিশ্চয়ই— এই ভাবে শুক-শারির দ্বন্দ্ব মিটে গেল! (একবার) সবাই মিলে চাঁদমুখে হরি হরি বল।
ছবি: কৌশিক সরকার
ঋতু যখন চিত্রাঙ্গদা করছে, তখন বেশ কয়েক বার আমার সঙ্গে মহাভারতের চিত্রাঙ্গদা নিয়ে কথা হয়েছে। মহাভারতীয় মূল কাহিনিটার আলোচনায় তৎকালীন সমাজের নিরিখে এক রাজা তাঁর মেয়েকে ছেলে হিসাবে মানুষ করছেন— এই ভাবনাটা ‘মহাভারত’য়ের কবি কী ভাবে ট্রিট করছেন, সেটা গভীর ভাবে আগে বুঝে নিয়েছে ঋতু। সে দিন আমার মনে আছে— স্ক্রিপ্ট পড়তে পড়তে ঋতু নাচের মুদ্রায় নেচে উঠেছিল ঘরের মধ্যে, নেচে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের অনুষঙ্গে। অনেক অনেক কথা হয়েছিল সে দিন, অনেক অনেক কথা। ঋতুর সঙ্গে ‘মহাভারত’ পড়ার একটা অন্য মানে আছে। পৃথিবীর বিচিত্র বিষয়ে এতটাই ওর পড়াশুনো ছিল, ছিল এত বিচিত্র জাগতিক বোধ, এত বুদ্ধি, এত সুন্দর কথা বলা, সেখানে আমার ‘প্রদান’য়ের সঙ্গে ‘আদান’য়ের ভাগ নেহাত কম ছিল না।
ব্যোমকেশ করার আগে আমাকে বলল— নৃসিংহদা, তুমি শরদিন্দুর ‘চোরাবালি’ দু’দিনে পড়ে ফেলো। পড়ে আমাকে বলো, প্রাচীন ভারতবর্ষে যারা একই গলায় বহু রকম আওয়াজ করতে পারত, তাদের একজনকেও কোথাও তুমি প্রাচীন সাহিত্যে খুঁজে পাও কিনা? এমন শব্দ যারা করতে পারত, তাদের নাম কী, কোনও উপাধি আছে তার?
বুঝেছিলাম, একটা গোয়েন্দা কাহিনি করার সময়ও অদ্ভুত একটা ভারতীয়তা কাজ করছে ওর মধ্যে। আমাদের দেশজ বস্তু, দেশজ ভাবনা কাজে লাগিয়ে অন্যতর ভাবে অনুপ্রাণিত কাহিনিকে ভারতীয়তায় সিক্ত করা যায় কি না, সেটা নিয়ে ভাবছিল ঋতুপর্ণ। হয়তো সেটা ছবির কোনও কাজেই লাগেনি শেষ পর্যন্ত। কিন্তু নতুন কিছু করার আগে নিজেকে এবং সেই সঙ্গে এর সহগামী বিশ্বাসের মানুষগুলিকেও চরম ব্যতিব্যস্ত করে নিয়ে অবশেষে এক সানন্দ বিশ্বনাথের কেন্দ্রে পৌঁছে যাওয়ার মধ্যেই ওর একটা বড় মহাভারতীয়তা আছে বলে মনে করি। মহাভারতকে ফিল্মে নিয়ে আসার কথা আমাকে অনেক বার বলেছে ঋতু। এর জন্য ও মনে মনে কাস্ট ঠিক করে ফেলত। উত্তেজনায় কথাও বলে ফেলত দু’একজন নায়ক বা নায়িকার সঙ্গে। ছবিটা ও কী ভাবে ভাবছে তারও অন্তর্জাত বিলিখনগুলি প্রকটা করে তুলত আমার সঙ্গে। আমি বলতাম— এই ছবিটা যখন করবি, তখন আমি মাঝে মাঝে সেটে যাব। ঋতু বলেছিল, সেটে আমি তোমার কোনও কথাই শুনব না, তার আগে তুমি আমাদের সবাইকে মহাভারতের কথা শোনাতে আরম্ভ করো, শুনে-টুনে আগে ঠিক করি— কোথায় তোমাকে রাখব আর কোথায় তোমাকে কাটব।
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল
আমাকে সেই কথকের আসনে বসিয়ে গেল ঋতু, একেবারে কথকের ভূমিকায়, অথচ আমার প্রধান শ্রোতা, প্রবর্তক শ্রোতা, প্রযোজক কর্তা চলে গেল কোথায়! আমার মনে আছে মহাভারতকে ফিল্মে নিয়ে আসার জন্য ঋতুর মনের মধ্যে অন্তঃক্রিয়া চলছিল বহু দিন ধরেই, সেই অন্তঃক্রিয়া আরও বেশ কিছু দিন হয়তো চলতও, কেননা একাধিক বিষয়ে ও যখন বৈপ্লবিক প্রকরণ তৈরি করত, সেগুলির মধ্যেও যখন নিজেকে স্থিত করতে পারত না, তখনই বুঝতাম এ হল সেই কবিজনোচিত যন্ত্রণা, যা নির্বিকল্পের দিকে পথ তৈরি করছে। ও বলত, সত্যজিৎ অনেক কাল ভেবেও মহাভারতটা করে গেলেন না। কিন্তু সেটা যদি আমাকে করতে হয়, তবে আমাকেও তো তপস্যায় বসতে হবে। একবার বলেছিল— সত্যজিৎ মহাভারতকে ধরার সময় ‘ডাইস প্লে’কে ধরে এগোবেন ভেবেছিলেন। আমি ভেবেছি নৃসিংহদা, আমি গান্ধারীকে ধরে এগোবো। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষে রণক্ষেত্রে এসে দাঁড়িয়েছেন গান্ধারী। ঝোড়ো হাওয়ায় হলুদ-হলুদ পাতা উড়ে পড়ছে বাষ্পাপ্লুতা গান্ধারীর গায়ে। দূরে একটা বড় আগুন জ্বলছে, চার দিকে ছিন্ন, কর্তিত ব্যবচ্ছিন্ন দেহ। গান্ধারী কৃষ্ণের সঙ্গে, যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগোচ্ছেন, মাঝে মাঝে দূর দৃষ্টিপাতে তাকাচ্ছেন সেই বড় আগুনটার দিকে।
এই চিত্রকল্প হয়তো একবার দেখা দিয়ে মুছে গিয়েছে ঋতুপর্ণের কল্পলোক থেকে। কিন্তু এক মহাকবির পাশাযুদ্ধের মুখড়া থেকে আর এক মহাকবি যখন এক রিক্তা রমণীর যন্ত্রণাদগ্ধ হৃদয় নিয়ে ছবি করার কথা ভাবে, তখনই বুঝি, পাশা খেলার জটিল জগৎ ছেড়ে ঋতুপর্ণ যেন এক মানবী হিসেবে দেখতে পায় এই মহা-ভারতকে। সে মানবী ছেড়ে গেল আমাদের, ছেড়ে গেল এক মহান শূন্যতা দিয়ে। এখন আমার মহাভারত-কথা কে শুনবে? তুই কি বিশ্বময় নিজেকে ছড়িয়ে দিয়ে গেলি!

আনন্দplus

তোমার পেছনে সারা দিন ঘুরে ঘুরে
শহরে কোথাও পার্কিং পাচ্ছি না।
ঝাপসা দুপুর বৃষ্টিতে ভেঙেচুরে
দেখতে চাইছে, তুমি জেগে আছ কি না।


হাওয়া ছিল জোর। গাছ পড়ে গেছে কিছু।
এতটা মেঘলা বহু দিন করেনি তো,
শোক হাঁটবে না। লোক হাঁটে পিছুপিছু,
না হলে হাওয়াই তোমাকে এগিয়ে দিত।


অকালশ্রাবণ। টিপটিপ। ঝমঝম।
এমন বৃষ্টি, কাউকে তো নিয়ে যাবে...
মনে পড়বার সময় বড্ড কম।
কবে আর কারা চলে যাওয়া নিয়ে ভাবে।


তোমার পেছনে সারাপথ ঘুরে ঘুরে
ভেতরে কোথাও আশ্রয় পাচ্ছি না।
কেন যে আবার বৃষ্টি নামছে দূরে...
দেখতে চাইছে, তুমি ঘুমিয়েছ কি না


শুধু কলকাতা, বৃষ্টির কলকাতা
তোমার কপালে পরিয়ে দিচ্ছে টিপ
ভিড়ের কিনারে একা পড়ে আছে ছাতা
সাবধানে যেও, অনেক দূরের দ্বীপ...



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.