শেষ অপ্রকাশিত বেপরোয়া সাক্ষাৎকার
ঋতু কথা
(১৯৬১-২০১৩)
আনন্দplus

ঋতুপর্ণ ঘোষকে অনেক দিন থেকে চিনি। তাই তাঁকে কী সম্বোধন করব, একটু অস্বস্তিতে পড়ছি।
গৌতম, আমি তোর সঙ্গে ইলেভেন-টুয়েলভ পড়েছি। ৩৫ বছর হয়ে গেল। প্লিজ, তুই আমাকে আপনি বলিস না। আপনি বললে যে উত্তরগুলো দেব, সেগুলো নিশ্চয়ই তুই চাস না।

ও কে। আমি ঋতুপর্ণ-র সঙ্গে এক ক্লাসে পড়েছি। কলেজে কিন্তু তোকে কোনও নাটকের ডিরেকশন-টিরেকশন দিতে দেখিনি। যদি দেখতাম, তাহলে বলতে পারতাম আমি ঋতুপর্ণ ঘোষের পরিচালনায় কখনও অভিনয় করেছি।
হা হা হা!

আমার প্রশ্নটা হল, আমি তো তবু তোর সঙ্গে পড়তাম, তুই তো যাকে তাকে অবলীলাক্রমে ‘তুই’ বলে দিস। শুনেছি সুপ্রিয়া দেবীকেও তুই বলিস।
আসলে আমার মনে হয় যে, বাংলা ভাষা এই সুবিধেটা দেয়। একটা আন্তরিকতার সুবিধে। তার মধ্যে কিন্তু অসম্ভ্রম নেই। একটা গভীর আপন করে নেওয়া আছে। আমি কিন্তু এমন কাউকে তুই বলি না, যাঁরা আমায় তুই বলেন না। আমায় যদি কেউ তুই না বলেন, আমি তাঁদের ‘তুই’ বলি না।

মানে সে ক্ষেত্রে ‘তুই’টা প্রত্যাহার হয়ে ‘তুমি’তে চলে আসে।
হ্যাঁ। আমাকে ‘তুমি’ বললে, আমি ‘তুমি’ বলি। কেউ ‘আপনি’ বললে বলি, বেশিক্ষণ ‘আপনি’ বলবেন না, আমি ‘তুমি’ বলতে শুরু করব। আমার মনে আছে, প্রথম যে দিন মৃণালদা (মৃণাল সেন)-র সঙ্গে রীনাদি (অপর্ণা সেন) আলাপ করিয়ে দিলেন, দীপঙ্কর দে-র মেয়ের বিয়েতে। মৃণালদা আমায় ‘আপনি’ বলতে থাকলে, রীনাদি বলল ‘তুমি’ বলতে, না হলে কিছু ক্ষণ পরেই আমি ‘তুমি’ বলতে শুরু করব।

এই ‘তুই’টা নিষ্ঠুরভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, এমন ক’বার হয়েছে?
বিজয়া রায় স্বয়ং। আমি বলতে গেলেই বলেছিলেন, “একদম তুই-তোকারি করবে না।” (হা হা হা) আমার খুব ভাল্লেগেছিল।

এই যে মাঝখানে মাঝখানে ঋতুপর্ণর কোনও খবর পাওয়া যায় না। একবার শুনলাম ঋতুপর্ণ খুব অসুস্থ। আমরা তো খুব কনফিউজড হয়ে যাই। হঠাৎ করে জগৎসংসার থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া। বাড়িতে চুপচাপ বসে থাকা। শুধু বাবা-মাকে নিয়ে সম্পাদকীয় লেখা। এটা কি ক্রিয়েটিভিটির একটা ম্যানিফেস্টেশন? নাকি এটা স্ট্র্যাটেজি?
কিছুই না। (একটু ভেবে) আমার জীবনটাই ইজ পারসিভড অন দি এজ। মানে আমার যদি সামান্য একটা চোখের অসুখ হয়, খবরটা বেরোবে ঋতুপর্ণ অন্ধ হয়ে গেছে। ফলে, আমার যে কোনও স্বাভাবিক অসুখ-বিসুখ করতে পারে, এটাই লোকে বিশ্বাস করতে পারে না। তুই যে সময়টার কথা বলছিস, যে সময়টায় আমাকে অনেক ভোগালো। সেটা হল আমার হিমোগ্লোবিন অনেকটা ‘ফল’ করে গিয়েছিল। আর আমি যেহেতু কুড়ি বছর ধরে ডায়াবেটিক, আমার কিডনির কতগুলো সমস্যা ছিল। আমার এই অ্যাবসেন্সটা অনেক ভাবে ইন্টারপ্রিটেড হতে পারে। এডস হওয়াও তার মধ্যে একটা। কোনও কিছুই বাকি নেই তাতে।
ছবি: নীল বি মিত্র
রিয়েল কারণটা কী?
রিয়েল কারণ ওই যেটা বললাম। এখনও আমাকে সপ্তাহে দু’টো করে ইনজেকশন নিতে হচ্ছে। এখন আমার হিমোগ্লোবিন ৮.৬। এটাকে ১০ অবধি না তুলতে পারলে... আর এটাও তো ঠিক, বয়স তো হচ্ছে, গৌতম। এই বয়েস যখন হচ্ছে তখন জীবনী শক্তিও তো... এই সাপোর্টগুলো দরকার। কিন্তু আমি জানি, আমি এই কথাগুলো বললে লোকের শুনতে ভাল লাগবে না।

আমাকে অনেকে যা সব বলল। আমার সহকর্মীরাও। প্রায় অবিচুয়ারি তৈরি করে রাখার মতো অবস্থা। সে জন্য তোকে ফোন করেছিলাম।
হ্যাঁ হ্যাঁ। বলছিলি বাড়ি বসে থাকিস না। তোর অ্যাংজাইটিটাও বুঝতে পেরেছিলাম।

কোথাও কোথাও মনে হয় যে, দু’টো ঋতুপর্ণ লুকিয়ে আছে একসঙ্গে। একটা ঋতুপর্ণ যে মননশীল, ভাল ছবি বানায়, অন্য ধরনের ছবি বানায়। আর একটা ঋতুপর্ণ যে অদ্ভুত অদ্ভুত জামা-কাপড় পরে অনুষ্ঠানে হাজির হয়। লোককে অদ্ভুত একটা শক দেয়। আর এই শক দিয়েই বোধ হয় সে মজা পায়। একটা ঋতুপর্ণকে তখন মনে হয় ভীষণ মননশীল, আর একটা ঋতুপর্ণকে ভীষণ লাউড। কোন ঋতুপর্ণ আসল?
লাউড মনে হয়, না ইররেভারেন্ড।?


ইররেভারেন্ড।
হতে পারে। এটা আমি বুঝি। বলা হয় না যারা প্রান্তিক মানুষ, সমাজ তাদের বোঝে না। তারাও যে সমাজকে বুঝতে দেয়, তা-ও নয়। তারাও যে খুব কো-অপারেট করে তা-ও নয়। এটা হয়তো একটা...

প্রতিবাদের ধরন?
প্রতিবাদের ধরন না হলেও এক ধরনের অস্তিত্ববাদের সংকট বলব। আমার সাজ পোশাকটাই যদি আমার এক্সিসটেন্স হয়। আমার আমিটা হয়। তা হলে একটু মুশকিল। আমার বরাবরই মনে হয়েছে, আমার সাজপোশাক যাই করি না, একটাই তো জীবন। আমি পুনর্জন্মে বিশ্বাস করি না। আমার যে ভাবে জীবনটাকে সেলিব্রেট করতে ইচ্ছে হয় করি। আবার যখন ইচ্ছে হয় করি না।

তোর যদি শাড়ি পরে সেলিব্রেট করতে ইচ্ছে হয় তা-ই করবি?
না, করব না। এটা একটা ভাল প্রশ্ন তুললি। করব না। কারণ আমি আমার মধ্যে অ্যান্ড্রোজিনিটাকে এক্সপ্লোর করতে ভালবাসি। তার দু’টো ফাইনাইট দিক আছে। একটা পুরুষ। অন্য ফাইনাইট দিক হল মহিলা।
তুই যদি আমাকে বলিস শাড়ি পরব কি না? না, আমি শাড়ি কোনও দিন পরব না। স্যুট-প্যান্টও কোনও দিন পরব না।
একদিন একজন প্রশ্ন করলেন, “স্যুট তো পরবেন না। ধুতি-পাঞ্জাবি পরবেন?” না, আমি তা-ও পরব না। লেহেঙ্গা চোলিও পরব না, শাড়িও পরব না। ইচ্ছে করে না।


কিন্তু এই যে গয়নাগাঁটি পরে হুটহাট বেরিয়ে যাওয়া। লোকে তো ভাবতে পারে মহাকাব্যের কোনও চরিত্র বেরিয়ে এল।
সেটা যদি ভাবে লোকে, ভাবুক না। পিনস্ট্রাইপ জামা আর টাইয়ের বাইরে ভাবুক না। লোকের জীবনেও তো একটু বৈচিত্র দরকার। লোকের তো এটাও বোঝা দরকার, যে বৈচিত্র থাকবে পৃথিবীতে। তার সঙ্গে আমরাও থাকব। সবাইকে একটা হেজিমনির মধ্যে ঢুকিয়ে নেওয়া হবে। কোনও ইন্ডিভিজুয়াল থাকবে না। এটা তো হতে পারে না।

পর পর তিনটে ছবি, ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’, ‘মেমরিজ ইন মার্চ’, ‘চিত্রাঙ্গদা’। তিনটেতেই তোর চরিত্রগুলো মেয়েলি ধরনের। একটা সময় মেয়েলি ছেলেদের যেমন বলা হত, ‘লেডিজ’। পরে বলা হত ‘হোমো’। এখন বলা হয় ‘ঋতুপর্ণ’।
এটার একটা বিবর্তন আছে কিন্তু। আমাদের ছোটবেলায় যখন স্কুলে পড়তাম এই ‘লেডিজ’ শব্দটা বলা হত। আমিও শুনতাম। কোনও পুরুষের মধ্যে একটু ফেমিনিন ব্যাপার থাকলে তাকে ‘লেডিজ’ বলা হত। ওইটুকুই। সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশনের সঙ্গে ইক্যুয়েট করা হত না। তার পরে ধরে নেওয়া হল যাদের মধ্যে একটু কমনীয়, নারী সুলভ ব্যাপার আছে তারা সবাই ‘গে’। এটা কিন্তু একটা অ্যাসাম্পশন। কেউ বলে দেয়নি যে, ও ‘গে’। একটা ব্যবহার হঠাৎ করে সেক্সুয়ালিটির মার্কার হয়ে গেল। আমি অনেক বার বলেছি, লেডিজ বলছ কেন? প্লুরাল কোরো না। লেডি বলো। এই ভাবে আমি কমব্যাট করতাম ওটার সঙ্গে। তার পরে শহর একটা ফেজ পেল। সেই ফেজটার নাম ঋতুপর্ণ। আমার কিন্তু সেটার জন্য আলাদা করে অপমানিত লাগে না। আমি কিছু কথা বলেছি, যেগুলো আমাদের দেশের যৌনতা বিচারের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে কতগুলো স্টেটমেন্ট।
শিল্পীরা কিন্তু কোনও হিসেব করে কথা বলে না। থিওরি পড়ে কথা বলে না। তারা জাস্ট বলে।


কখনও কি মনে হয়, আমি একটা ক্রিয়েটিভ মানুষ। আমার মূল্যায়নটা কাজে হওয়া উচিত। আমি মেয়ে না ছেলে, এটা নিয়ে লোকেদের এত দোলাচল কেন?
তুই যেটা বলছিস এ রকম একটা আইডিয়ালিস্টিক সিচ্যুয়েশন তো হওয়ার নয়। এত মিডিয়া, এত কিছু। ব্যক্তিকে নিয়ে এখন এত লেখা হয়। তাতে এটা কমপ্লিটলি উড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এক সময় দর্শকরাই বলতেন, আমি সত্যজিতের উত্তরসূরি। কিন্তু সত্যজিৎ রায় একটা ম্যাসকুলিনিটি রিপ্রেজেন্ট করতেন। বাঙালি সেটাকে ওয়ারশিপ করত। সেলিব্রেট করত। ওই রকম হাইট। ইংরেজি বলা। ব্যারিটোন। অত পাশ্চাত্য গান শোনা। সব মিলিয়ে টিলিয়ে রোল মডেল অব ম্যাসকুলিনিটি। যে লোকটা সত্যজিতের উত্তরসূরী, তার ম্যাসকুলিনিটিকে ভায়োলেট করার কোনও অধিকার নেই। তখনই এই ওলটপালট হয়ে গেল। বাট দে কান্ট ইগনোর মি। দে আর ফন্ড অব মাই ওয়ার্ক। দর্শকরা আমার ব্যাপারে খুব প্রোটেকটিভ। তারা আমাকে খুব ভালবাসে। কিন্তু দে কান্ট ডিল উইথ মি অলসো।

তোকে ঘিরে এই যে মাঝেমাঝেই নানান ধরনের খবর তৈরি হয়, এটার নিজের কাছে কোনও এক্সপ্ল্যানেশন আছে?
না। মানে এক সময় ভাবতাম, এটা তো আমি করিনি। এটা রটল কেন? যে মানুষটার সেক্সুয়ালিটি নিয়েই সাসপেক্ট সারা শহরে, সেই লোকটার সেক্স লাইফ নিয়ে অপরিমাণ কৌতূহল (হা হা হা)।

আরও দু’টো বিশেষণ দিতে চাই। অপরিসীম। অপর্যাপ্ত।
(হা হা হা) অ্যাবসোলিউটলি। কৌতূহলটা অপরিসীম। কৌতূহলটা অপর্যাপ্ত।

যিশুর সঙ্গে বেশ কয়েকটা ছবিতে কাজ করলি। অনেকে ঠাট্টা করে বলছে সত্যজিৎ-সৌমিত্র।
সে তো এক সময় প্রসেনজিৎকেও বলা হত। মানে যখন আমি বুম্বার সঙ্গে অনেকগুলো ছবি করেছি। (অনেকক্ষণ চুপ থেকে) আমার সেটা মনে হয় না। আমার মনে হয় না এখন আর সৌমিত্র চ্যাটার্জি নতুন করে তৈরি করা সম্ভব। সৌমিত্রদা অনেক জিনিস ন্যাচারালি নিয়ে এসেছিলেন। বাংলা ভাষার প্রতি একটা দরদ ছিল। বাংলা ভাষায় কবিতা লিখতেন। আর সত্যজিৎ রায় যখন হিরো তৈরি করছেন, তখন ধরে নিতে হবে এলিট বাঙালির জন্য হিরো তৈরি করছেন। এখন কেমন একটা ‘ফ্রি ফর অল’ হয়ে গিয়ে, কেমন একটা হয়ে গিয়েছে। এখন কেউ মনে করে না ভাষাটা আমায় জানতে হবে, যে ভাষায় আমি অভিনয় করব। ভাষাটা যে আমার জানা দরকার। সেটা না জেনে, চেহারাটা জাস্ট ভাল বলে অভিনয় করতে চলে এলাম। আমি যিশুকেও খুব ভালবাসি। বুম্বাকেও নিয়ে যথেষ্ট যত্নে কাজ করিয়েছি। আমার মনে হয়, আমি আর একটু খাটলে দু’জনের মধ্যেই যে সম্ভাবনা ছিল সেটা আরও এক্সপ্লোর করা যেত। সৌমিত্রদার সঙ্গে তুলনাটা আজ বোধহয় আর কারও ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়।

প্রসেনজিৎ-যিশু দু’জনের সঙ্গেই কাজ করেছিস। সেক্স কোশেন্ট কার বেশি? এক থেকে দশের মধ্যে যদি মার্ক করতে হয়।
বুম্বা।

কেন?
বুম্বা এত দিন ধরে একটা রোম্যান্টিক হিরোকে বেশ সাকসেসফুলি প্লে করেছে। এই যে একজনের জীবনে এতগুলো বিয়ে। সব সময় রোম্যান্স। আমার একজন অ্যাসিসট্যান্ট প্রশ্ন করেছিল, কেন আমি বারেবারে বুম্বাকে নিই? তখন ‘খেলা’র শ্যুটিং চলছে। আমি বললাম ওর চোখের পাতাটা দেখ। ওর চোখটা দেখ। বুম্বা চাইলেই অলটাইম একটা চার্মিং, রোম্যান্টিক হিরোর চরিত্র প্রোজেক্ট করতে পারে। যেটা আমি আর চট করে কাউকে দেখিনি করতে।

তোকে নিয়ে বুম্বার সঙ্গে ফিল্মমহলে গসিপ হয়েছিল সেটা কি তুই জানিস?
হ্যাঁ। সেটা আমিও জানি। বুম্বাও জানে।

কী ভাবে হ্যান্ডেল করলি সেটা?
ওটাকে হ্যান্ডেল করার দরকার বলেই আমি মনে করি না।

কারওরই সেটা মনে হয় না?
না, কারওরই সেটা মনে হয় না।

ইদানীং কালের বিশাল হিট ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’। এই ইন্ডাস্ট্রিই সাত-আট বছর আগে একটা হিটের জন্য ঋতুপর্ণ ঘোষের দিকে তাকিয়ে বসে থাকত। এই যে নানান ডিরেক্টরেরা আসছেন। ‘বাইশে শ্রাবণ’ হচ্ছে, ‘অটোগ্রাফ’ হচ্ছে, ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ হচ্ছে। খুব ভাল ভাবে ইন্ডাস্ট্রি এগোচ্ছে। ঋতুপর্ণ ঘোষের কি কোথাও মনে হয় না যে, আমি সেই লোকটা যে খেলাটাকে কমপ্লিটলি বদলে দিয়েছিল? সে এখন আর শিরোনামে নেই কেন?
হ্যাঁ। একটা সময় রাস্তা ছেড়ে দিতে হয় বইকী। কিন্তু জানতে হয়, কখন সরে যেতে হয়। আমি কুড়ি বছর ইন্ডাস্ট্রিতে আছি। আমি যদি আজও ‘উনিশে এপ্রিল’ করে যেতাম, ‘দহন’ করতাম, তাহলে সুইসাইড করতাম। মানে আমাকেও তো আমার গতিপথটাকে বদলাতে হয়েছে। আমি কিন্তু কেবল টালিগঞ্জের প্রত্যাশা পূরণের জন্য ছবি করি না। আমার যে ছবিটা করতে ভাল লাগে না বা যে ছবিটা করতে গিয়ে আমার নতুন কিছু শেখা হবে না, জানা হবে না, আমার মধ্যে যে ফিলটা আছে সেটা দিয়েই একটা ছবি করে ফেলব সে ছবি আমি আর করব না।
কারণ একজন ফিল্ম মেকারের আয়ু খুব বেশি দিন নয়। তার ফ্যাকাল্টিগুলো যখন আস্তে আস্তে ডিজলভ করে, তখন তাকে সরে যেতে হয়। আর জাস্ট একটা গল্প বলার ন্যারেটিভ ছবি তো আমি করেছি। আমার তো আর নতুন করে প্রমাণ করার দরকার নেই।


কিন্তু নিজের কি কখনও মনে হয় না, একটা সময় অন্য ধরনের ছবি মানেই ঋতুপর্ণ ঘোষ। আজকে সেখানে নতুন মুখ উঠে আসছে। মনে হয় না আবার ওই স্কিলটা টেস্ট করে দেখি? যেমন বুম্বা কমার্শিয়াল ছবি করল একটা। কিছুই না, শুধু দেখার জন্য যে, আমার ওই জায়গার ধারটা অক্ষত আছে কি না? জাস্ট সে রকম কখনও মনে হয়েছে?
না রে ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং এটা আমার মনে হয়নি। আমার হাত দিয়ে যেটা হয়েছে, সেটা অন্য কারও হাত দিয়েও ঘটতে পারত যে, বাঙালি আবার হলে ফিরে এসেছে।

মানে বাঙালিয়ানার প্রত্যাবর্তন?
হ্যাঁ, বাঙালিয়ানার প্রত্যাবর্তন। আর আমি যে বয়েসে ছবি করছি, দেখবি আমি রীনাদি, গৌতমদার সঙ্গে ব্র্যাকেট হয়ে গেলাম। অঞ্জন আমার অনেক আগে ছবি করতে এলেও। ও কিন্তু সৃজিত, টোনির সঙ্গে এক ব্র্যাকেটে পড়ে গেল। আমার তাতে কোনও অসুবিধা নেই। আমার কাজ সব সময় আমার থেকে বড় ডিরেক্টরের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। ফলে সেটা তো একটা সৌভাগ্য।

লোকের তো আরও অনেক চাহিদা আছে ঋতুপর্ণ ঘোষের কাছে।
ওই যে বললাম, চাহিদা পূরণ করার জন্য তো অনেকগুলো নতুন জায়গা তৈরি হয়েছে। আর কেবল দর্শকের চাহিদার জন্য ছবি করতে রাজি নই। তার মানে এই নয় যে, দর্শকের চাহিদাটা আমার কাছে ইম্পর্ট্যান্ট নয়। দর্শকের চাহিদা তৈরি করাটাও কিন্তু একজন ফিল্মমেকারের কাজ। আমি কুড়ি বছর আগে যেটা করেছিলাম, সেটাই আমার কাছ থেকে চাইবে না। তারা আমার কাছে থেকে আরও বেটার কাজ ডিমান্ড করবে। আর সেই বেটার ডিমান্ড তৈরি করাটাও তো আমার কাজ।

কিন্তু সেই ক্যাপটিভ অডিয়েন্সের প্রতিও কি তোর দায়বদ্ধতা নেই যারা ঋতুপর্ণকে ঋতুপর্ণ করেছে?
তারা যদি সত্যিই ঋতুপর্ণকে ভালবাসে, ঋতুপর্ণ-এর কাজের প্রতি যদি শ্রদ্ধা বা সহানুভূতি থাকে, তারাও নিশ্চয়ই একবার দেখতে চেষ্টা করবেন এক্সপেরিমেন্টটা কোথায় হচ্ছে। বলবেন, আচ্ছা দেখি কী হচ্ছে। কারণ দর্শক পাল্টানোরও তো একটা দায় ফিল্মমেকারের থাকে। আমি কয়েকটা সহজপাচ্য এন্টারটেনমেন্ট দিয়ে ছবি করে দিলাম, সেটাও তো ঠিক নয়।

কিছু দিন আগে বুম্বা একটা ইন্টারভিউতে বলেছে, তোর অভিনয় করার দরকার কী? তোর প্রথম ছবিতে লোকে জেনে নিয়েছে তুই ভাল অভিনয় করিস। তোর অধীনে যারা অভিনয় করেছে, তারা সবাই বলেছে তুই অসাধারণ দেখাস।
আমি তো আর শুধু আমার ছবিতে অভিনয় করিনি। কৌশিকের ছবিতেই তো প্রথম করলাম। আর প্রথমেই যদি আমি ‘চিত্রাঙ্গদা’ করতাম, তা হলে একটা কথা ছিল। অন্য ডিরেক্টরের কাছ থেকে অফার পাওয়ার একটা ডিগনিটি আছে বুঝলি? আমি তো যে কোনও দিন নিজের জন্য একটা চরিত্র লিখে কাস্ট করতে পারতাম।

তার মানে ‘চিত্রাঙ্গদা’র বীজ বপন হয়ে গিয়েছিল ওই ছবিটা পাওয়ার সময়ই?
না, তারও আগে। আমার মনে হয়েছে আমার ছবিতে যে আধুনিক অভিনয় আমি চাইছি, আমার পাত্র-পাত্রীরা ততটা আধুনিক অভিনয় দিতে পারছে না। তাই মনে হয়েছিল একবার অন্তত করে দেখা যাক না। এই করে দু’টো ছবি হল। তার পরের ছবিতে দু’টো রোল প্লে করলাম। পরেরটা দীপ্তি নাভালের ছবিতে আমি আর রাইমা অভিনয় করলাম। তার পর ‘চিত্রাঙ্গদা’। ‘চিত্রাঙ্গদা’য় অন্য কারওকে পেলে আমি নিজে করতাম না। কিন্তু কাউকে পেলাম না যে আমার ছবির জন্য অতখানি ওড়িশি নাচ শিখবে। এবং একটা সেক্স চেঞ্জ অপারেশনের প্রত্যেকটা ধাপ বুঝে। মেডিক্যালি বুঝে, সেটাকে অভিনয়ের মধ্যে আনবে।

তখন আমাকে অনেক নায়িকা বলেছিলেন, “ঋতুদা আমাদের দেখাচ্ছেন আমাদের আসলে কী করা উচিত। আমাদের লজ্জাই লাগছে। এখানে কেউ রোলের জন্য এতটা স্যাক্রিফাইজ করে না। যেটা লোকে হলিউডে করে।” এটা কি কোথাও ছিল যে, হয়তো কিছুটা বিরক্ত হয়েই যে, এটাই হচ্ছে স্কেল?
না, সেটা তো করতেই হবে। বিশ্ব সিনেমা কেন আমাদের স্কেল হবে না? কোয়েল বেটার করল, না স্বস্তিকা বেটার করল, টালিগঞ্জ তার মধ্যে আটকে থাকবে কেন? পৃথিবী যেখানে আমার দিগন্ত, সেখানে কেন টালিগঞ্জ নিয়ে মাথা ঘামাব? আর এটা ঠিক আমি কতগুলো প্রসিডিওর ডেভলপ করতে চেয়েছিলাম। এখানে সবাই টেক নেওয়ার পরে দৌড়ে মনিটরে শট দেখতে যায়। আমি যেতাম না। কস্টিউম নিয়ে ভেবেছি। খেতে গেলে একটা অয়েলক্লথ পরে নিতাম। যেগুলো আমাদের অভিনেতা অভিনেত্রীরা কখনও সচেতন ভাবে করেনি।

এর পরে কি মনে হচ্ছে, এদের মধ্যে কিছুটা হলেও সেই বোধ কাজ করছে? যে একটা স্ট্যার্ন্ডাড অন্তত সেট হয়ে গিয়েছে।
সেটা তো করেই। সেটে এখন সবাই বাংলা বলে। অতটা জড়িয়ে ইংরেজি বলে না। রাইমা পুরো ‘নৌকাডুবি’টা নিজে ডাব করল। ও তো বাংলায় বলতে পারত না।

এ বার কি আমরা অবিমিশ্র পরিচালক ঋতুপর্ণকে ফেরত পেতে পারি?
(বেশ কিছুক্ষণ চুপ) হুউউউ... আমার কিন্তু অভিনয় করতে ভাল লাগে না। আমি বেঁচে থাকতে চাই পরিচালক হিসেবে। অভিনেতা হিসেবে নয়। রাজেন তরফদার যেমন ‘আকালের সন্ধানে’তে অভিনয় করেছিলেন। সেটুকুই থাক না। সেটা নিয়ে তো কেউ রাজেনবাবুর পরিচালনার ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। অত বড় পরিচালক সেই মাপটা কোথাও কমে যায়নি। আমিও বেঁচে থাকতে চাই পরিচালক হিসেবে।

এই যে ‘আমার অন্যদের ছেড়ে দিতে হবে’ এমন কথা তো সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনের মুখে শোনা যায়নি। এক্ষুনি এগুলো মাথায় আসছে কেন?
দেখ, সত্যজিৎ রায় করেছেন ঠিকই। লাস্ট তিনটে ছবি কিন্তু আমার ভাল লাগেনি। ওটাই তো শিক্ষা, যে লোকটার কাজ দেখে আমি শিখেছি, তাঁর ভুলগুলো দেখেই তো আমি শিখব। একটা সময় পর দাঁড়ি টানতে হয়। আর গৌতম, আমি একটা জিনিস বুঝে গেছি, বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসে যদি ৫০০ জন পরিচালকের নাম লেখা হয়, তাতে আমি আসব না। তা হলে কেন আমি আমার যা ইচ্ছে তাই করব না। তা হলে আমি কেন ঝুঁকি নেব না। আমি কিছুই করব না, এই ৫০০ জনের ছবি দেখে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব।

কে বলে দিল ৫০০ জনের মধ্যে নাম আসবে না?
আমার নিজের ইভ্যালুয়েশন।

সেটাও তো চ্যালেঞ্জ হতে পারে, যে এমন একটা ছবি তৈরি করব যেটা ওই ৫০০-র ওপরের দিকে থাকবে।
বিশ বছর কাজ করেও যদি আমি বুঝি সে সম্ভাবনা আমি কখনওই তৈরি করিনি। তা হলে আর কেন চেষ্টা করব।

একটা প্রশ্ন না করে পারছি না, এই যে ক্রমাগত নিজেকে মিসআন্ডারস্টুড হতে দেখা। এটা কেমন লাগে?
একটা প্রবলেম কী জানিস? আমাদের ধারণা জীবদ্দশাতেই আমাদের জীবনী বেরিয়ে যাবে আর সেটার সংশোধনটাও আমরাই করে যাব। সেটা তো হওয়ার নয়। (কিছু ক্ষণ চুপ থেকে) আমি যদি এই মিসআন্ডারস্টুড হওয়ার বেদনা নিয়ে বেঁচে থাকি, আর আমার অ্যাপ্রিসিয়েশনের আনন্দকে উপভোগ না করি, তা হলে আমি কেন বেঁচে আছি। আমাকে তো কত মানুষ ভালবাসে। কত মানুষ কত কথা বলতে পারে না, কিন্তু আমার কাজের মধ্যে খুঁজে পায়। তখন মনে হয় তাদের ভালবাসা আমায় ভিজিয়ে দিচ্ছে।

এই যে বাঙালি তোর ছবি দেখতে ছুটে আসছে। তোর কাজ দেখতে চায়। তোর কাজের ব্যাখ্যা করতে চায়। তখন কি মনে হয় না আর একটু
ঝুঁকি নিই?
আমি তো সেটাই করার চেষ্টা করছি। তুই তো আমাকে বারে বারে ‘উনিশে এপ্রিল’, ‘দহন’য়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছিস (হা হা হা)।

এই যে তুই অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে কাজ করলি। উনি তো এই বয়েসেও কাজ করে যাচ্ছেন। ওঁকে পাশ থেকে দেখেও মনে হল না আমি একটু ইন্সপায়ার্ড হই?
না... না... না... আমার মনে হল সারভাইভালটা যত বড় ক্রাইসিস, কোয়ালিটি লাইফ লিড করা ততটা ইম্পর্ট্যান্ট নয়।

তোকে অনেক জায়গায় শুনি আবৃত্তি করতে। তোর পছন্দের একটা কবিতা শোনা।
উউউ... শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দ-ভৈরবী’। কবিতাটা আমার খুব পছন্দের। এখন হুবহু মুখস্থ আছে কি না জানি না। লাইনগুলো এ রকম,
আজ সেই ঘরে
এলায় পড়েছে ছবি
এমন ছিল না আষাঢ় শেষের বেলা
উদ্যানে ছিল বরষা-পীড়িত ফুল
আনন্দ-ভৈরবী
আজ সেই গোঠে আসে না রাখাল ছেলে
কাঁদে না মোহনবাঁশিতে বটের মূল
এখনও বরষা কোদালে মেঘের ফাঁকে
বিদ্যুৎরেখা মেলে।


তোর গলায় শুনতে খুব ভাল লাগল। খুব ভাল লাগল। আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি, সৃষ্টিশীল মানুষকে তো সব সময় একটা লক্ষ্য তাড়া করে বেড়ায়। নিজের জন্য কী লক্ষ্য রেখেছিস? বাকি জীবনের জন্য কী ভেবেছিস?
আমার একটাই... (কিছু ক্ষণ চুপ)। তুই যদি আমায় জিজ্ঞেস করিস, “ধর, তুই আর ছ’মাস বেঁচে থাকবি, ওই ছ’মাস পর তুই মরে যাবি। এ বার তুই কী করবি ডিসাইড কর।” তা হলে বলব, আমি একটা ‘মহাভারত’ রচনা করব। মানে, আমার যদি আলটিমেট ডিজায়ার কিছু থাকে, এখনও পর্যন্ত সেটাই। আবার এটাও তো ঠিক, ডিজায়ারও তো চেঞ্জ করে (বেশ কিছু ক্ষণ নিস্তব্ধ)। আর এই ডিজায়ার চেঞ্জ করার গল্পই তো ‘চিত্রাঙ্গদা’। ডিজায়ারটাও চেঞ্জ করে। দ্য ডিজায়ার অলসো হ্যাজ আ লাইফ অব হিজ ওন। তাই আমরা ইচ্ছেকে এক জায়গায় পৌছিয়ে বলি, এখানে থেমে যাও। কিন্তু আমরা যদি ইচ্ছের সঙ্গে হাঁটতে পারতাম। সেই জার্নিটা আরও মনোরম হত।

পুনশ্চ...



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.