পুনশ্চ
টেলিফোনে শেষ দেখা ১৫ মে। গান স্যালুটের ঠিক দু’সপ্তাহ আগে।
ও-ই ফোন করেছিল— পত্রিকার ‘মৃণাল ভুবন’ নিয়ে কিছু কথা বলার জন্য। ঋতু এমন একজন মানুষ। সরি, ঋতু এমন একজন মানুষ ছিল যাকে ফোনেও দেখতে পাওয়া যেত। আমি ঘনিষ্ঠ ভাবে চিনতাম দু’জন ঋতুপর্ণকে। একজন পরিচালক। একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সকাল ৮টার মধ্যে ফোনে কথা হয়ে যাওয়া মানে সাধারণ ভাবে দুই পুরনো বন্ধুর সংলাপ। সাড়ে ৯টার পর ফোন মানে, এক সাংবাদিক এবং এক উত্তেজিত পরিচালকের উত্তপ্ত এক্সচেঞ্জ। ততক্ষণে কাগজ পড়ে, আনন্দবাজারের এন্টারটেনমেন্ট কভারেজে নির্ঘাত ঘোর আপত্তিকর কিছু খুঁজে পেয়েছে ঋতু।
গত দশ বছরে ঋতু এবং ওর করা কাজ নিয়ে দু’টো মহাবিতর্কিত লেখা বার হয়েছিল পত্রিকায়। একটা ‘বাড়িওয়ালি’ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রের অন্যায়ভাবে সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার পাওয়া নিয়ে। কিরণ খের যে ডাবিং নিজে করেননি, সেটা ঋতু কেন জাতীয় পুরস্কারমণ্ডলীকে জানায়নি, আমরা প্রশ্ন তুলেছিলাম। যা পরে জাতীয় সিনে বিতর্ক হয়ে দাঁড়ায়। আর একটা ইন্টারভিউ বেরোয়, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর। যেখানে তিনি বলেন জাতীয় পুরস্কারের জন্য ঋতু ওঁকে অ্যাপ্রোচ করেছিল।
ঋতু শুধু প্রধান সম্পাদককে অভিযোগ করেই থেমে যায়নি। একটা দীর্ঘ দেড় ঘণ্টার ফোনে আমায় আটকে রেখেছিল। তার পরের কথা না-ই বা বললাম।
সেই ঋতুই আবার বন্ধু হিসেবে যখন এসেছে, শ্রাবণের ধারার মতো ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে। অন্য কাগজের সাময়িকী সম্পাদক হয়েও আনন্দplus-এ ব্যাকরণটা বুঝতে চেয়েছে। পত্রিকার পাতা নিয়ে উদার পরামর্শ দিয়েছে। শনিবারের পত্রিকার ফিল্ম রিভিউতে সঙ্গে যে ইন্ট্রো নেওয়া উচিত, সেটা ওরই আইডিয়া।
আশ্চর্য— গত আট মাসে পরিচালক ঋতুপর্ণকে খুঁজেই পাইনি। ঝগড়ার কোনও ব্যাপারই ছিল না। বরঞ্চ এমন একটা মানুষকে সাতসকালে আবিষ্কার করতাম যে, শিশুর মতো বেজায় অসহায়, বিভ্রান্ত আর বিষণ্ণ। সে কোথাও যেন বন্ধুত্ব খুঁজছে। বিশ্বাস খুঁজছে। জীবনের রোদ্দুরকে খুঁজছে। কিন্তু পেরে উঠছে না। তার যেন ক্রমশই মনে হচ্ছে সে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। এই ঋতুকে আগে কখনও দেখিনি।

এমনই একদিনের সকাল।
মার্চ ’১৩

এই প্রজন্মের কাছে তুই যে একটা রোল মডেল সেটা ভাবিস না। তোর লজ্জা করে না!
কেন রে এত রেগে যাচ্ছিস?

কেন রে, মানে? তুই রবিবার কাগজে যে সম্পাদকীয় লিখিস- সেটা খুললে রোজ মৃত্যু। তোর ছবি দেখলে মৃত্যু। ‘আবহমান’ কী একটা ছবি বানিয়েছিস। সারা ক্ষণ সব কিছু মেঘলা।
হাঃ হাঃ তোর ‘আবহমান’ ভাল লাগেনি?

তোকে হয়তো অনেকে ভাল বলেছে। কিন্তু প্লিজ আমাদের মতো অ্যাভারেজ দর্শকদের কথাও ভাব। যারা তোর ছবিতে বেঁচে থাকা দেখতে চায়। খালি ঘ্যানঘ্যানে বিষণ্ণতা নয়।
তোরা তো বেঁচে থাকা ছবি প্রচুর পাচ্ছিস গৌতম। এক একজনকে সত্যজিৎ রায় বানিয়ে দিচ্ছিস।

ঋতু, বিশ্বাস কর, আধুনিক সময়ের শ্রেষ্ঠ পরিচালক তুই। তোর জায়গাটা একদম আলাদা।
সত্যি বিশ্বাস করিস?

সত্যি বিশ্বাস করি। সবাই করে। এই সে দিন দীপঙ্কর দে-র সঙ্গে এয়ারপোর্টে বসে লম্বা আড্ডা হচ্ছিল। উনি তোর খুব প্রশংসা করছিলেন।
তাই? টিটোদা বলছিল? তুই সত্যি বিশ্বাস করিস যেটা বললি।

সত্যি বিশ্বাস করি। তুই সে দিন রোটারি সদনের ডিবেটে এসে ‘বাইশে শ্রাবণ’-য়ের একটা ডায়লগ নিয়ে যেটা বললি, না বললেই পারতি।
(চুপ)

ঋতু, তুই খেলা ভালবাসিস না বলে জানিস না। স্পোর্টসে খুব লেখা হয়। ফর্ম ইজ টেম্পোরারি। ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট। তুই কিন্তু ক্লাস। তোর সম্পর্কে খালি অসুস্থ শুনতে হয় কেন?
খুব ভাল লাগল রে তোর কথা শুনে। ঠিক আছে তোকে কথা দিলাম আর তিন মাস দে। আর আমার সম্পর্কে অসুখবিসুখ শুনবি না।

মাঝ এপ্রিল

ঋতু, বাড়াবাড়ির সীমা আছে। সুজয় ঘোষ কী করে ব্যোমকেশ হয় রে?
কেন হয় না।

ঋতু। ব্যোমকেশ বলতে বাঙালি মনে যে ইমেজারি ভেসে ওঠে তার সঙ্গে সুজয় কি যায় নাকি রে? তুই কি ঋতুপর্ণ বলে যা-ইচ্ছে-তাই করবি।
শোন, তুই জ্ঞান দিস না। তোদের পত্রিকার পাতায় ফিল্ম রিভিউয়ের যা স্ট্যান্ডার্ড বানিয়েছিস সেটা আগে অ্যাড্রেস কর।

মাঝ মে

শোন ‘মৃণাল ভুবন’ নিয়ে তোদের ডিপার্টমেন্ট থেকে আমায় ফোন করেছিল। আমি অনেক কিছুতেই একমত নই মৃণালদার সঙ্গে। কিন্তু সেটা বলিনি।
বলিসনি কেন?

কারণ আমার মনে হয়, মৃণালদার জন্মদিনটা আমাদের সেলিব্রেট করা উচিত। জন্মদিন ইস্যু নিয়ে বিতর্ক তৈরি করতে চাইনি। আমায় ভুল বুঝিস না। ইন্টারভিউটা মৃণালদার নিজের ভাল লেগেছে। উনি অভীকদাকে ফোনও করেছিলেন।
তাই? ঋতু তোর ইন্টারভিউটা কবে দিবি জানাস। তুই নিজে যবে ঠিক মনে করবি বলিস।


হ্যাঁ, তোকে ফোন করব ইন্টারভিউটা নিয়ে।
দয়া করে একটা ভাল ছবির খবর দিস। সেটা নিয়ে করব। মৃত্যুটৃত্যু নয়। অনেক মেঘলা আকাশ দেখিয়েছিস।

না না করব। কামব্যাক করব রে। তোর ভাষায় একটা সানসাইন ছবির খবর দেব। বিশ্বাস কর আমি এখন মোটিভেটেড। থ্যাঙ্ক ইউ রে।
আচ্ছা তুই সে দিন সৌরভের কী একটা লাইন বলছিলি, আর এক বার বলবি?
সৌরভের নিজের লাইন না ঋতু। সৌরভের কিটব্যাগে নিউজিল্যান্ডের সাইকোলজিস্টের পরামর্শ।
তোমার চাকরিতে যদি সমস্যাই না থাকে, সেটা কোনও চাকরি নয়!


কী দারুণ রে লাইনটা। ভেরি ইন্সপায়ারিং।
ঋতু তোর কাজগুলোও ভীষণ ইন্সপায়ারিং। নতুন ডিরেক্টররা সবাই বলে।


থ্যাঙ্ক ইউ রে বাবু। আমি তোকে জানাচ্ছি। ইন্টারভিউটা আনন্দplus-এ নিবি না পত্রিকায়?
আনন্দplus-এ। আমি নেব না, প্রিয়াঙ্কা নেবে।

ইন্দ্রাণী পার্কের বাড়িটায় ৩০ মে সকালে ঢুকতে গিয়ে মনে হল, এ বাড়িটার ঠিক উল্টো দিকে বছর সাতেক আগে যে দিন ঐশ্বর্যাকে নিয়ে ‘চোখের বালি’র শ্যুটিং চলছিল সে দিন এর অর্ধেক মাতামাতি দেখিনি। পরিচালক নয়, এ তো মনে হচ্ছে কোনও মহানায়কের মৃত্যু হয়েছে। দিনভর বাঙালি ডুবেওছিল সেই ঋতুপর্ণ-বিষণ্ণতায় যে দুঃখটা ঋতু নিজের ছবিতে তৈরি করত।
এক এক সময় মনে হচ্ছিল এটা রিয়েল হতে পারে না, নির্ঘাত কোনও ফিল্মের দৃশ্য। ঋতু যে স্বাভাবিক অভিনয়ের কথা বলত, সেটাই। রাত্তিরে টিভিতে ওর গান স্যালুট নেওয়া দেখতে দেখতে মনে হল, পাঁচ মাস আগে যদি সেদিন বিশ্বাস করত যে, সত্যিই ও আধুনিক যুগের সেরা পরিচালক। তা হলে বোধহয় মৃত্যুর সিন ও এত তাড়াতাড়ি ডেকে আনত না।
ওপরে দেখা তো হবেই। অভিযোগ দিয়ে সে দিন শুরু করব ঠিক করে ফেলেছি— কী রে ঋতু, তোর সানসাইন ছবির কী হল? মোটিভেশন নিয়ে এত কথাটথা বলে তুই তো শেষে ঋত্বিক ঘটক হয়ে গেলি রে!