সরকারি হোমে মাত্র পাঁচ মাসে মৃত ৩২ জন! প্রত্যেকেই মানসিক ভারসাম্যহীন ভবঘুরে। মুর্শিদাবাদের কান্দির মহালন্দিতে মানসিক ভারসাম্যহীন ভবঘুরেদের হোমে ২০১২-র অগস্ট থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে আবাসিকদের এই মৃত্যু মিছিলের কারণ জানাতে গিয়ে প্রশাসনিক কর্তারাই বলছেন, ‘‘ভয়াবহ অপুষ্টি ও চিকিৎসকের অভাব’’-এর কথা। তবে এ নিয়ে সরকারি নড়াচড়া সবে শুরু হয়েছে।
গত ডিসেম্বরে ৩২তম মৃত্যুর পরে (২১ জন পুরুষ, ১১ জন মহিলা) জেলা প্রশাসন বিষয়টি জানায় সমাজকল্যাণ দফতরকে। চিঠি পাঠায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও। তাতে রাজ্যর হেলদোল নেই বলে অভিযোগ। রাজ্যের টনক নড়েছে এতদিনে, যখন ১৭ মে হোমগুলির অবস্থা দেখতে গঠিত রাজ্য পর্যায়ের বিশেষ কমিটির সদস্যেরা সেখানে যান। মহালন্দি কলোনিতে ‘হোম ফর লুন্যাটিক ভ্যাগর্যান্টস’ ঘুরে ২৭ মে সমাজকল্যাণ দফতরে দেওয়া রিপোর্টে কমিটি জানিয়েছে, মৃত্যুর মূল কারণ অপুষ্টি।’
চমকে দেওয়ার মতো নানা তথ্য এসেছে ওই রিপোর্টে। লেখা হয়েছে, আবাসিকদের জন্তুর মতো একটি-দু’টি ঘরে গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে। সন্ধ্যা হলেই সেই ঘরে তালা পড়ে। আবাসিকদের জন্য সরকার যা অর্থ দিচ্ছে, তা সঠিক খরচ হচ্ছে না। দীর্ঘদিন ‘অডিট’ হয়নি। কমিটির কৌতূহল, কেন সরকারি সাহায্য সত্ত্বেও অপুষ্টিতে আবাসিকদের মরতে হচ্ছে? |
মহালন্দির মানসিক ভারসাম্যহীনদের হোমে আবাসিকরা। গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি। |
ওই বিশেষ পরিদর্শন কমিটির প্রধান অশোকেন্দু সেনগুপ্ত বলেন, “ডাক্তার নেই, নার্স নেই, খাবার জল নেই, কর্মী নেই। আবাসিকদের পরিচ্ছন্নতা বা হোমের নিকাশি-ব্যবস্থা শোচনীয়। এত অল্প সময়ে এত মৃত্যু নিয়েও এত দিন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অবিলম্বে বিশেষ অডিট করে দেখা হোক, সরকারি টাকা কোথায় গেল?”
মুর্শিদাবাদের অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) রবীন্দ্রনাথ সরকার বলেছেন, “ময়না-তদন্তের রিপোর্টে নিউমোনিয়া, টিবি, ডায়েরিয়া-র মতো নানা কারণ লেখা থাকলেও আদতে অপুষ্টির কারণেই এই পরিস্থিতি বলে জানা গিয়েছে। এই হোমে পরিকাঠামো ঢেলে সাজার দরকার আছে।” ২২ বছর ধরে এই হোমে রয়েছেন অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার রত্না চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বক্তব্য, “ছোট জায়গায় টিবি বা ডায়েরিয়ার রোগীদের সঙ্গে বাকিদের গাদাগাদি করে রাখা হয়। সেখান থেকে সংক্রমণ ছড়ায়। ডাক্তারও নেই। ফলে, আবাসিকেরা মারা যান।”
কিন্তু কেন আবাসিকদের এত অপুষ্টি? কেন ডাক্তার রাখা হয় না?
রাজ্যের কমিশনার (ভ্যাগর্যান্সি) বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর জবাব, “আমরা আবাসিকপিছু মাসে ১,৪৫০ টাকা দিই। তার মধ্যে ৯৫০ টাকা খাবারে খরচ হয়। এতে পরিমাণমতো ভাত-মসুর ডাল-আটা-গুড়-সবজি, মাসে ১৩৫ গ্রাম মাছ, দু’দিন ডিম, সপ্তাহে এক দিন মুরগির মাংস পাওয়ার কথা।” কিন্তু মহালন্দি হোমে গিয়ে দেখা গেল, আবাসিকদের পাতে পড়ছে পোকা-খাওয়া চাল, জলের মতো ডাল, বিস্বাদ তরকারি। তবে হোমের বর্তমান ম্যানেজার আকবর আলি-র দাবি, “খাবারের মান আগের থেকে ভাল।”
হোমে থাকার কথা ১০০ জন পুরুষ আবাসিকের। আছেন ১৩৬ জন। ১০০ জন মহিলা আবাসিকের জায়গায় রয়েছেন ৯৯ জন। পুরুষ বিভাগে তিনটি আলোবাতাসহীন ঘরে ঠাসাঠাসি করে ১৩৬ জনকে (টিবি, নিউমোনিয়া, ডায়েরিয়া রোগী-সহ) রাখা হয়েছে। একটি খাটিয়ায় মরণাপন্ন অবস্থায় পড়ে রয়েছেন ঘনশ্যাম অগ্রবাল নামে এক আবাসিক। তার পুরুষাঙ্গ ঘা হয়ে প্রায় খসে পড়ছে। অথচ, হোমে ডাক্তার নেই যে দেখবেন। অ্যাম্বুল্যান্সও বহু দিন বিকল।
রাজ্যের সমাজকল্যাণ সচিব রোশনি সেন বলেন, “মরণাপন্ন ভবঘুরেদের এই সব হোমে পাঠানো হচ্ছে। তার উপরে ডাক্তারের অভাব। সরকারি মাইনে কম বলে বিজ্ঞাপন দিয়েও চিকিৎসক পাওয়া যাচ্ছে না। অডিট রিপোর্ট চাইছি। মহালন্দি হোমের পরিকাঠামো উন্নয়নে টাকা ইতিমধ্যে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।” শুধু এই হোমই নয়, মুর্শিদাবাদ-নদিয়ার আরও ক’টি হোম নিয়ে রিপোর্ট করেছে কমিটি। যেমন, নদিয়ার কৃষ্ণনগরে মেয়েদের শেল্টার হোমে ‘স্যানিটরি ন্যাপকিন’ দেওয়া হচ্ছে না। মুর্শিদাবাদের কাদাই এলাকায় অনাথ ছেলেদের হোম চালু হয় ২০১০-এ। তাতে ১০ জন কর্মী রয়েছেন। কিন্তু এক জনও আবাসিককে রাখা হয়নি। |