হওয়ার কথা ছিল সরকারি হাসপাতাল বা সরকারি পলিক্লিনিক।
কিন্তু আদতে হয়ে গেল সিপিএমের পার্টি অফিস, পুর-নিগমের ওয়ার্ড কমিটির দফতর, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের স্কুল, ময়লা ফেলার গাড়ি রাখার জায়গা, রাজমিস্ত্রিদের বিশ্রামের আস্তানা আর তান্ত্রিকের আখড়া!
হাওড়ার শিবপুরে শালিমার দু’নম্বর গেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ১৮ কাঠা জমির উপরে প্রাসাদোপম ওই দোতলা বাড়ি নিজেদের হাতে থাকা সত্ত্বেও রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর তা কোনও কাজে লাগাতে পারছে না বলে অভিযোগ। উল্টে বছরের পর বছর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ওই ভবনটি হানাবাড়িতে পরিণত হচ্ছে আর একে একে বাড়ির বিভিন্ন অংশ বেদখল হয়ে যাচ্ছে।
জায়গার অভাবে এমনিতেই বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজের সম্প্রসারণ থেকে শুরু করে ডাক্তারির ছাত্রছাত্রীদের হস্টেল তৈরি পর্যন্ত একাধিক কাজ ধাক্কা খাচ্ছে। এই রকম পরিস্থিতিতে হাওড়ার শহরাঞ্চলে কলকাতার কাছে এত বিশাল এলাকা ও বাড়ি কেন ব্যবহার করছে না স্বাস্থ্য দফতর? এই প্রশ্ন উঠেছে স্বাস্থ্য দফতরের অন্দরেই। কী ভাবেই বা তা বেদখল হচ্ছে?
১৪ নম্বর দেবেন্দ্র গাঙ্গুলি রোডের ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, সামনের জমিতে পুরসভার ময়লা ফেলার গাড়িগুলি ফেলে রাখা হয়েছে। একতলায় কয়েকটি ঘরে হাওড়া পুর-নিগমের ওয়ার্ড কমিটির অফিস হয়ে গিয়েছে। তার পাশের ঘরেই পুরোদস্তুর সিপিএমের পার্টি অফিস। দলীয় পতাকা, মার্কস-লেনিনের ছবি। পিছনের কিছু ঘরে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা দিব্যি স্কুল চালাচ্ছে! কয়েকটি ঘর আবার দখল করেছেন এক তান্ত্রিক বাবাজি। সঙ্গে তাঁর চেলারাও। |
হাওড়ায় রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের সেই বাড়ি। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার |
এঁদের ঢুকতে দিল কে? স্বাস্থ্য দফতরের জায়গায় সিপিএমের পার্টি অফিস বা পুর-নিগমের ওয়ার্ড কমিটি গড়ার অনুমতি কারা দিলেন? হাওড়ার মেয়র মমতা জয়সোয়াল সব শুনে অবাক স্বরে বললেন, “আমি তো এই বাড়ি সম্পর্কে কিছুই জানতাম না!”
হাওড়ার মুখ্য স্বাস্থ্য-অধিকর্তা (সিএমওএইচ) দেবাশিস রায় কিন্তু জানিয়েছেন, তিনি গোটা ব্যাপারটা নিয়ে বীতশ্রদ্ধ। গত ডিসেম্বরে সিএমওএইচ-এর দায়িত্ব নেওয়ার পরেই তিনি বাড়িটির অবস্থা সরেজমিন দেখতে যান। ছবিও তুলে আনেন। তাঁর কথায়, “কী বিশাল জায়গা আর বাড়ি ভাবা যায় না। সেটা কি না এত অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে! দোতলা ভেঙে পড়ছে। প্রশাসন এত দিন কী করেছে, বুঝতে পারছি না।”
দেবাশিসবাবুর বক্তব্য, “আমি ডিস্ট্রিক্ট রিসার্ভ স্টোর আর চাইল্ড অ্যান্ড মেটারনিটি হাবের জন্য হন্যে হয়ে জায়গা খুঁজছি। অথচ, অত বড় একটি জায়গা পড়ে আছে! ডিসেম্বর মাসে স্বাস্থ্য ভবনকে রিপোর্ট দিয়েছিলাম। পাঁচ মাস কেটে গেল। কিছুই হল না।”
১৯৭৫ সালে শিবপুরের বাসিন্দা, জনৈক ব্রজহরি রায়চৌধুরী হাসপাতাল অথবা পলিক্লিনিক গড়ার জন্য এই জায়গা ও বাড়ি স্বাস্থ্য দফতরকে দান করেন। সেই সময়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন অজিত পাঁজা। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত সেখানে রমরম করে কেএমডিএ-র পলিক্লিনিক চলেছে। সেখানে ১০-১৫ টাকা দিয়ে গরিব মানুষ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দেখাতে পারতেন। কিন্তু ১৯৯২ সালে পলিক্লিনিক বন্ধ হয়ে যায়। তার পরে আর ওই বাড়িটি স্বাস্থ্য দফতর কোনও কাজে লাগায়নি।
দেবেন্দ্রবাবুর নাতি সমীরকুমার রায়চৌধুরী এই বাড়ি নিয়ে এক সময়ে বাম সরকারকে চিঠির পর চিঠি দিয়েছেন। আর তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে মুখ্যসচিব, স্বাস্থ্যসচিব সকলকে চিঠি দিয়ে ফেলেছেন। তাঁর একটাই আবেদন, “আমাদের পরিবার থেকে স্বাস্থ্য দফতরকে বাড়িটি দেওয়া হয়। তা কেন ২০ বছর ধরে পড়ে থাকবে আর দখল হয়ে যাবে? ফেলে রাখার জন্য তো দেওয়া হয়নি।”
স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর কথায়, “১৯৯২ সালের পরে কেএমডিএ সব পলিক্লিনিক তুলে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন শিবপুরের ওই পলিক্লিনিকও বন্ধ হয়ে যায়। তার আসবাবপত্র-চিকিৎসা সরঞ্জাম পাঠিয়ে দেওয়া হয় দক্ষিণ হাওড়া স্টেট জেনারেল হাসপাতালে।”
কিন্তু তার পরে ২১ বছর কেন স্বাস্থ্য দফতর বাড়িটি ব্যবহার করল না? কী করে বাড়ির বিভিন্ন অংশ বেদখল হয়ে গেল? কে অনুমতি দিল স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে স্কুল করার বা পার্টি অফিস চালু করার?
স্বাস্থ্য-অধিকর্তার উত্তর, “এগুলি প্রশাসনিক ব্যাপার। কারণটা আমি বলতে পারব না। তবে হাওড়ার জেলাশাসক ও মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তা আমাকে ওই বাড়ি নিয়ে রিপোর্ট দিয়েছেন। সেখানে কিছু দিনের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি যৌথ প্রচেষ্টায় ডায়াগনিস্টিক ক্লিনিক বা পলিক্লিনিক চালু করার চেষ্টা হচ্ছে।” |