কলকাতার এক বিশিষ্ট চিকিৎসকের কাছ থেকে কিছু দিন আগেই মেল পৌঁছেছে সুদূর সুইৎজারল্যান্ডের এক বিজ্ঞানীর কাছে। এক নতুন ধরনের কৃত্রিম হাত বা ‘আর্টিফিশিয়াল লিম্ব’ তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছিলেন ওই বিজ্ঞানী। এমন হাত যা কি না ফেরত আনবে স্পর্শসুখের অনুভূতি, যা দিয়ে ধরে-ছুঁয়ে বিভিন্ন বস্তুকে পরখ করতে পারবেন ব্যবহারকারীরা। সম্প্রতি তিনি জানিয়েছেন, সে চেষ্টা অনেকটাই সফল। তাঁকে তাই তড়িঘড়ি মেল করেছেন এ শহরের প্লাস্টিক সার্জন মণীশমুকুল ঘোষ।
আসলে কিছু দিন আগেই বস্টনে আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর দা অ্যাডভান্সমেন্ট অফ সায়েন্সের কনফারেন্সে কৃত্রিম হাত নিয়ে নিজেদের গবেষণার ফল জানিয়েছিলেন অধ্যাপক সিলভেস্ত্রো মাইসেরা। যা শুনে বিশেষজ্ঞদের আশা, নতুন ওই হাত অনেকটাই কাজ করবে আসল হাতের মতো। সে হাত থেকে বার্তা যাবে মস্তিষ্কে।
মিলবে সংবেদন।
অধ্যাপক মাইসেরার কাজে উৎসাহিত মণীশমুকুলবাবু বললেন, “একটি বাচ্চা মেয়ে দুর্ঘটনায় নিজের হাতের সামনের অংশ খুইয়ে আমার কাছে এসেছিল। তাকে কোনও ভাবে সাহায্য করা যায় কি না, সে জন্যই অধ্যাপক মাইসেরাকে মেল করেছি।” বলা বাহুল্য, মণীশমুকুলবাবুর মতো অনেকেই অধ্যাপক মাইসেরার গবেষণার দিকে তাকিয়ে। কারণ, বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সুইজারল্যান্ডের ‘ইকোল পলিটেকনিক ফেদেরেল দে লোজানে’ (ইপিএফএল)-এর এই বিজ্ঞানী ও তাঁর দলের প্রচেষ্টা সফল হলে অনেকেই মুক্তি পেতে পারেন পঙ্গুত্বের অসহায়তা থেকে।
কী ভাবে?
ইপিএফএলের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, দুর্ঘটনা কিংবা বিষাক্ত ঘা নানা কারণে অনেক সময়ই রোগীর প্রাণ বাঁচাতে হাতের সামনের অংশ কেটে বাদ দেন চিকিৎসকেরা। এতে প্রাণে বাঁচলেও চির জীবনের মতো অসহায়ত্ব থেকে যায় রোগীর মধ্যে। সেই অসুবিধা অনেকাংশে কাটিয়ে দেবে তাঁদের তৈরি নতুন হাত। কারণ, এই বিশেষ হাত (প্রস্থেটিক) মস্তিষ্কে সংবেদন পাঠাতে সক্ষম। অনেকটা ঠিক আসল হাতেরই মতো। আর ঠিক এখানেই বাজার-চলতি বাকি আর্টিফিশিয়াল লিম্বগুলির থেকে আলাদা এটি।
কাটা হাতে কৃত্রিম হাত লাগানো অবশ্য শল্যচিকিৎসার দুনিয়ায় নতুন কিছু নয়। কিন্তু অধ্যাপক মাইসেরার দাবি, তাঁদের তৈরি ‘বায়োনিক হ্যান্ডে’ অভিনবত্ব রয়েছে। তিনি জানাচ্ছেন, বাজার চলতি প্রস্থেটিকগুলির অধিকাংশই শুধুমাত্র মস্তিষ্ক থেকে আসা সঙ্কেত গ্রহণে সক্ষম। অর্থাৎ তারা খালি মস্তিষ্কের হুকুম পালন করতে পারে। কিন্তু সেগুলি কোনও বার্তা মস্তিষ্কে পাঠাতে পারে না। ফল? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনও বস্তু ছুঁয়ে বা ধরে পরখ করার অনুভূতি পান না ব্যবহারকারীরা। বাইরের জগতের সঙ্গে সম্পর্ক বা যোগাযোগটা তাই অসম্পূর্ণই রয়ে যায়। এই অসম্পূর্ণতার জায়গাটাই কাটাতে পারবে বায়োনিক হ্যান্ড।
ইপিএফএলের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এই যান্ত্রিক হাত দিয়ে কোনও বস্তুকে ধরে বা ছুঁয়ে অনুভব করতে পারবেন ব্যবহারকারীরা। যন্ত্র হলেও মানুষের দেহের সঙ্গে দিব্যি খাপ খাইয়ে নিতে পারবে এই বায়োনিক হ্যান্ড। অর্থাৎ এ হাত দিয়ে ফেরত আসবে স্পর্শসুখের অনুভূতি। আবার ফেরত মিলবে যন্ত্রণার অনুভূতিও।
অন্তত সে রকমই ঘটেছিল পিয়েরপাওলো পেত্রুজ্জিয়েলোর সঙ্গে। ২০০৯ সালে পরীক্ষামূলক ভাবে তাঁর কাটা হাতে জোড়া হয় এই বায়োনিক হ্যান্ড। দেখা গিয়েছিল নিজের ইচ্ছায় ওই হাতের আঙুল নাড়াতে পারছেন পিয়েরপাওলো। হাতের মুঠোয় ধরতে পারছেন ছোটখাটো জিনিস। এমনকী তালুতে সূচ ফোঁটালে অনুভব করছেন ব্যথাও।
যদিও বিষয়টি নিয়ে কিছুটা সন্দেহ রয়েছে চিকিৎসক মহলের মধ্যেই। যেমন কলকাতার বিশিষ্ট প্লাস্টিক সার্জন অনুপম গোলাস বললেন, “প্রযুক্তির দিক থেকে হয়তো এমন ঘটনা সম্ভব। কিন্তু পুরো বিষয়টার সাফল্য অনেকাংশেই নির্ভর করছে ব্যবহারকারীর উপর। বায়োনিক হ্যান্ড এক ধরনের রোবোটিক হাত। সেই হাত কী ভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে, তা খানিকটা ব্যবহারকারীর বুদ্ধি এবং প্রশিক্ষণের উপর নির্ভরশীল।” একই সঙ্গে তাঁর মতে, আংশিক সংবেদন পাঠাতে সক্ষম হলেও যান্ত্রিক হাত পুরোপুরি সজীব হাতের মতো সংবেদন পাঠাতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েই যাচ্ছে।
উৎসাহিত হলেও বিষয়টি নিয়ে সন্দিহান মণীশমুকুলবাবুও। তাঁর মতে, পুরো বিষয়টি প্রমাণিত হতে এখনও কয়েক বছরের ধাক্কা। তার আগে তার বাণিজ্যিক প্রয়োগও সম্ভব নয়। আপাতত তাই পরীক্ষা-নিরীক্ষার স্তরেই রয়ে যাচ্ছে বায়োনিক হ্যান্ডের স্বপ্ন।
যদিও অধ্যাপক মাইসেরার দাবি, যে মডেলটি রোমের এক বাসিন্দার হাতে এ বছর পরীক্ষামূলক ভাবে লাগানো হবে, সেটি বিশেষজ্ঞদের সন্দেহ দূর করবে অনেকাংশেই। কারণ ২০০৯ সালের থেকেও উন্নত এই মডেল। এখন অপেক্ষা শুধু অস্ত্রোপচারের। এর মাধ্যমে কৃত্রিম হাতটিকে সরাসরি জুড়ে দেওয়া হবে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের সঙ্গে। হাতের প্রধান দু’টি নার্ভ, মিডিয়ান এবং আলনার-এর উপর লাগিয়ে দেওয়া হবে দু’টি ইলেকট্রোড যা কি না মস্তিষ্কের সঙ্কেত বয়ে নিয়ে যাবে হাতে এবং হাতের সংবেদন পাঠাবে মস্তিষ্কে। আর এই আদানপ্রদানের কৌশলেই ‘সজীব’ হয়ে উঠবে বায়োনিক হ্যান্ড।
অস্ত্রোপচারের পরেও মাসখানেকের অপেক্ষা। রোগীর শরীর কী ভাবে খাপ খাওয়াচ্ছে এই নতুন অতিথির সঙ্গে, তার উপরই নজরদারি চলবে সে সময়ে। ফল আশানুরূপ হলে শুরু হবে বিশদ গবেষণা। শোধরানো হবে নানা রকম ত্রুটি-বিচ্যুতিও।
তত দিন পর্যন্ত হাতে ‘হাত’ দেওয়ার তাগিদে কাজ করে যাবেন ইপিএফএলের বিজ্ঞানীরা। |