দেওয়াল তুমি কার?
বাড়ির মালিকের, না যে পার্টি দখল করেছে তার?
পঞ্চায়েত নির্বাচন সামনেই। তাই জেলায় জেলায় শুরু হয়ে গিয়েছে দেওয়াল দখল। চুনকাম করে এক কোণে দলের নাম লেখায় ব্যস্ত রাজনৈতিক কর্মীরা।
লাল-নীল-সবুজ আখরে ফুটে উঠছে ‘বিষমদে মারা গেলে ২ লাখ / আর চিটফান্ডে টাকা গেলে ব্যাড লাক / তাই না দিদি?’ বা ‘হাত-হাতুড়ি-কাস্তে তারা / এদের করুন বাংলাছাড়া’।
কিন্তু ফ্লেক্স, বা্যানার, মোবাইল-পাবলিসিটির যুগেও দেওয়াল লিখন নিয়ে এত উত্তেজনা কেন?
বিভিন্ন দলের জেলা নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ফ্লেক্স, বা্যানারের তুলনায় দেওয়াল লেখার খরচ কম। গ্রামীণ এলাকায় দেওয়াল চুন করে, রং ও তুলি কিনে একটা ১০০ বর্গফুটের দেওয়াল লিখতে খরচ পড়ে কমবেশি ১০০ টাকা। সঙ্গে থাকে যিনি দেওয়াল লিখবেন, তাঁর খাওয়ার খরচ। পেশাদার শিল্পীরা লিখলে দেওয়ালের মাপ অনুযায়ী খরচ পড়ে দেওয়াল পিছু ১০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। |
অনেক সময় ১,০০০ টাকার বিনিময়ে সারাদিন যত খুশি দেওয়াল লেখার চুক্তিও হয়। অন্য দিকে, ভাল মানের ফ্লেক্সের খরচ ২০০ টাকারও বেশি। গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে যাঁরা প্রার্থী হন, তাঁদের অনেকেই নিম্নবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য। তাই তাঁরা দেওয়াল লিখনের মাধ্যমেই প্রচার করেন। এ ছাড়া অনেক গ্রামে ফ্লেক্স, ব্যানার তৈরি করার লোকও নেই।
অনেক সময় দলীয় সমর্থকেরাও দেওয়াল লেখার জন্য টাকা পান। উত্তর দিনাজপুরের পতিতপাবন পাল যেমন। বললেন, “কংগ্রেস করি। দলের দেওয়াল লিখি। দেওয়াল পিছু ৫০-৬০ টাকা পাই। দল যদি রং, তুলি কিনে দেয় তা হলে সেটা হয় ৩০-৪০ টাকা। তাঁর আক্ষেপ, “রঙের দাম বেড়েছে। এই টাকায় হয়তো আর দেওয়াল লেখা যাবে না।” দেওয়াল লেখায় রয়েছে বেশ কয়েকটি ধাপ। প্রথমে দেওয়াল ঘষা, পরে চুন লেপা হয়। শেষ ধাপে পেন্সিল দিয়ে ‘আউটলাইনিং’ বা ‘লেটারিং’-এর পরে বা সরাসরি রং পড়ে দেওয়ালে। হাওড়ার ডোমজুড় পঞ্চায়েত সমিতির বিরোধী দলনেতা সিপিএমের সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, “আমাদের দলে পোস্টার ও দেওয়াল লেখার কর্মশালা হয়। তারপরে কিছু বাছাই কর্মী দেওয়াল লেখার কাজ শিখতে শুরু করেন।” ডোমজুড় পঞ্চায়েত সমিতিরই বন ও ভূমি কর্মাধ্যক্ষ ও তৃণমূল নেতা প্রভাত ঘোষ বলেন, “১৯৭৮ সাল থেকে দেওয়াল লিখছি। দলে যাঁরা ভালো দেওয়াল লিখতেন, তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে দেওয়াল লেখা শিখেছি।”
রাজ্য তৃণমূল ছাত্র পরিষদের কার্যকরী সভাপতি পার্থপ্রতিম প্রামাণিক বলেন, “ছোটবেলায় সন্দেশখালিতে গ্রামে দলের জন্য দেওয়াল চুনকাম করতাম। আমাদের দলে কর্মীরাই বেশিরভাগ দেওয়াল লেখেন। তাতে খরচ বাঁচে।”
মোটামুটি সব রাজনৈতিক দলই জানাচ্ছে রীতি অনুযায়ী, কোনও নির্বাচনের আগে দেওয়াল লেখার বিষয় কী কী হবে সেটি লিখিত আকারে রাজ্য নেতৃত্ব পাঠিয়ে দেন জেলা নেতৃত্বকে। তৃণমূল সূত্রে খবর, এ বার পঞ্চায়েত ভোটের আগে তাদের লেখা দেওয়ালে মূলত রাজ্যের উন্নয়নের প্রচার ও বিরোধীদের ‘কুৎসা’র জবাব দেওয়া হবে। পক্ষান্তরে সিপিএম অন্দরের খবর, এ বার দেওয়াল লিখনে প্রাধান্য পাবে কৃষকের আত্মহত্যা, ফসলের দাম না পাওয়া, সারের মূল্যবৃদ্ধির মতো বিষয়। পঞ্চায়েত ভোটে যেহেতু স্থানীয় বিষয় অনেক সময় প্রাধান্য পায়, তাই রাজ্য নেতৃত্বের ঠিক করা বিষয়ের বাইরে গিয়েও অনেক সময় দেওয়াল লেখেন স্থানীয় নেতৃত্ব। ইতিমধ্যেই হাওড়ার বাগনান, জগদীশপুর, উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট, দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়, হুগলির তারকেশ্বর, হরিপালের মতো এলাকায় শুরু হয়ে গিয়েছে দেওয়াল লেখা।
শুরু হয়ে গিয়েছে মন কষাকষিও। হুগলি জেলা সিপিএম নেতা রূপচাঁদ পালের অভিযোগ, “শাসক দলের নেতারা পেশিবলে আমাদের দেওয়াল দখল করছেন।” যদিও অভিযোগ অস্বীকার করে হুগলি জেলা তৃণমূল সভাপতি তথা বিধায়ক তপন দাশগুপ্ত বলেন, “বাড়ির মালিকের অনুমতি নিয়ে আমাদের দলের কর্মীরা দেওয়াল লিখছেন। যাঁরা আগে ভয়ে সিপিএমকে দেওয়াল লিখতে দিতেন, এখন তাঁরাই স্বেচ্ছায় আমাদের দেওয়াল দিচ্ছেন।” পঞ্চায়েতের দেওয়াল-যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। |