গঙ্গা-পদ্মা ভাঙন রোধে কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা ফরাক্কা ব্যারেজ কর্তৃপক্ষের ভূমিকার বিরুদ্ধে সরব হলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের হস্তক্ষেপের দাবি তুলে সম্প্রতি দিল্লিতে চিঠিও পাঠিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কেন্দ্রের তরফে অবিলম্বে ব্যবস্থা না নেওয়া হলে আসন্ন বর্ষায় পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও মালদা জেলার একটা বড় অংশে ভাঙন ও বন্যার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে বলেই মনে করেন মমতা।
মুখ্যমন্ত্রী তাঁর চিঠিতে জানিয়েছেন, ফরাক্কা ব্যারেজ প্রকল্পের এলাকা বাড়ানোর জন্য রাজ্যের তরফে প্রস্তাব দেওয়া হলেও তা নিয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্তই নেয়নি কেন্দ্র। এমনকী ফরাক্কা ব্যারেজ প্রকল্প এলাকায় মধ্যে মুর্শিদাবাদ ও মালদার বেশ কয়েকটি অঞ্চলে কাজ করার জন্য বহু বার ব্যারেজ কর্তৃপক্ষকে আবেদন জানানো হলেও তার কোনও কাজই হয়নি। ব্যারেজ কর্তৃপক্ষ অর্থাভাবে কাজ করতে পারছেন না বলে দাবি করছেন। এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী যেন কেন্দ্রীয় অর্থ এবং জল সম্পদ মন্ত্রককে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন, চিঠিতে সেই আর্জিও জানিয়েছেন মমতা। রাজ্যের সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ভাঙন রোধে ফরাক্কা ব্যারেজের সমস্যা নিয়ে গত ২৫ মে দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লেখেন মুখ্যমন্ত্রী। ২৮ মে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে চিঠির প্রাপ্তি স্বীকারও করা হয়েছে।” |
কিন্তু এখনও পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর তরফে সেই চিঠির কোনও উত্তর মেলেনি বলেই সরকারি সূত্রের খবর। এর আগে, ২০১২-তেও ফরাক্কা ব্যারেজ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছিলেন মমতা। সেই চিঠির বিষয় ছিল, ব্যারেজের ১৩ এবং ১৬ নম্বর স্লুইস গেট খারাপ থাকায় ফরাক্কার জলের ক্ষেত্রে কী ভাবে পশ্চিমবঙ্গ বঞ্চিত হয়েছে এবং বাংলাদেশ অনেক বেশি জল পেয়েছে। ওই বছরেই ফেব্রুয়ারি মাসে দিল্লি গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জাতীয় সন্ত্রাস দমন কেন্দ্র (এনসিটিসি), তিস্তা চুক্তি, লোকপাল বিল, জিটিএ বিল নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি ফরাক্কার জলের বিষয়টি নিয়ে বৈঠক করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই বৈঠকের পরের দিনই ফরাক্কায় গাফিলতি খুঁজতে তৎপর হয় কেন্দ্র। এর পরেই অবশ্য ওই গেট দু’টি মেরামত করা হয়। তার পরে রাজ্যও প্রয়োজনীয় জল পেয়েছে বলে রাজ্য সেচ দফতরের কর্তারা জানিয়েছেন।
ফের ফরাক্কা ব্যারেজের উদাসীনতার কারণে আসন্ন বর্ষায় মালদার ভুতনিদেওয়ারা, ডোমহাট, শিমুলতলা এবং মুর্শিদাবাদের হুসেনপুর, হাসানপুর, কুলিদেওয়ারা, ইসলামপুর, বয়রা, ময়া, কান্দি, কামালপুর-সহ বিভিন্ন এলাকায় ভাঙন ও বন্যার আশঙ্কায় প্রধানন্ত্রীকে চিঠি দিলেন মুখ্যমন্ত্রী।
সব থেকে বিপজ্জনক অবস্থা ভুতনিদেওয়ারার। সেখানে বাঁধের ৪০০ মিটার অংশ ভাঙা অবস্থায় রয়েছে। দু’টি জেলা মিলিয়ে মোট ১১.৪ কিলোমিটার এলাকা ভাঙন প্রবন বলেই মনে করেন সেচের কর্তারা। মুখ্যমন্ত্রীর চিঠির আগে বেশ কয়েক বার কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রী ও বিভাগীয় সচিবকে চিঠি পাঠিয়ে ও মৌখিক ভাবে সমস্যার কথা জানিয়েছিলেন রাজ্যের সেচমন্ত্রী। রাজীববাবুর অভিযোগ, “যে অংশে ওঁদের কাজ কাজ করার কথা, সেটুকুও করছেন না! উল্টে আমাদের টাকা খরচ করে কাজ করতে হচ্ছে! সামনেই বর্ষা আসছে। এখন ব্যবস্থা নিয়েও কোনও লাভ হবে কি না, বুঝতে পারছি না।” সেচ দফতর সূত্রে খবর, ২০০৫ সালের ৫ জানুয়ারি তৎকালীন কেন্দ্রীয় জলসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টচার্যের কাছে ফরাক্কা ব্যারেজ প্রকল্পের সীমানা বৃদ্ধি করার প্রস্তাব দেন। বুদ্ধদেববাবুও তাতে সম্মতি দেন। এর পরে ১৯ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রক থেকে একটি অর্ডার প্রকাশ করে। তাতে ঘোষণা করা হয়, মালদায় অর্থাৎ ফরাক্কা ব্যারেজের উজানে ৪০ কিমি এবং মুর্শিদাবাদে অর্থাৎ ব্যারেজের ভাটিতে ৮০ কিমি এলাকা বাড়ানো হল।
সেচ আধিকারিকদের দাবি, মোট ১২০ কিমি এলাকার ভাঙন রোধে যাবতীয় কাজকর্ম করার কথা ছিল ফরাক্কা ব্যারেজ প্রকল্প কর্তৃপক্ষ-র। কিন্তু প্রথম থেকেই মালদা ও মুর্শিদাবাদ জুড়ে সামগ্রিক ভাঙন রোধে রাজ্য সরকারকেও সমান্তরাল ভাবে কাজ করতে হয়েছে। গত দু’বছরে ওই ১২০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে মুর্শিদাবাদে ভাঙন রোধে ৫০.৯ কোটি টাকা খরচ করেছে রাজ্য সেচ দফতর। সেখানে ব্যারেজ কর্তৃপক্ষ খরচ করেছেন ১৯.৪২ কোটি টাকা!
তবে মালদায় কিছু কাজ ব্যারেজ কর্তৃপক্ষ করেছেন বলে সেচ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে। রাজীব বলেন, “যেটা কেন্দ্রের করার কথা, সেই কাজ আমাদের খরচ করে করতে হচ্ছে। ওই টাকা থাকলে আমরা জেলার অন্য কাজে তা লাগাতে পারবো।”
মালদা ও মুর্শিদাবাদে গঙ্গা-পদ্মা ভাঙন রোধে কেন্দ্রীয় সরকার যাতে আরও তৎপর হয়, সে জন্য ২০১১ এর ২৯ সেপ্টেম্বর মুখ্যমন্ত্রীর কথা মতো তৎকালীন সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইয়া মালদায় ৬৫ কিমি এবং মুর্শিদাবাদে সাড়ে ৯৮ কিমি ব্যারেজ প্রকল্পের সীমানা এলাকা বাড়ানোর জন্য কেন্দ্রের কাছে প্রস্তাব পাঠান।
কিন্তু বেশ কয়েক বার বলা হলেও সে বিষয়ে কেন্দ্রের তরফে কোনও সদুত্তর মেলেনি। পাশাপাশি ভাঙন রোধের কাজে ফরাক্কা ব্যারেজ প্রকল্প কর্তৃপক্ষ যাতে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন, সেই বিষয়েও বহু বার তাঁদের চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন সেচ কর্তারা। এমনকী দিল্লিতে গিয়ে এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রী হরিশ রাওয়াতের সঙ্গেও কথা বলেন রাজীব। চলতি বছরের এপ্রিলে কেন্দ্রীয় জলসম্পদ দফতরের সচিব এ রাজ্যের সেচ ও জলসম্পদ দফতরের সঙ্গে বৈঠক করতে কলকাতায় এলে তাঁকেও বিষয়টি জানানো হয়। কিন্তু অর্থাভাবের কথা তুলে ফরাক্কা ব্যারেজ কর্তৃপক্ষ ভাঙন রোধে কোনও ব্যবস্থাই নিতে রাজি হচ্ছেন না বলে অভিযোগ রাজ্যের সেচমন্ত্রীর।
সব মিলিয়ে এ বারেও বর্ষায় ফের গঙ্গা-পদ্মা ভাঙনের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। |