তিনি কোনও একটি হাসপাতালের জাঁদরেল মেট্রন ছিলেন। অনেক দিন কলকাতার নামী হাসপাতালে আর তার পর মফস্সলের কোনও এক জেলা হাসপাতালে। তিনি আমার এক বন্ধুর পিসি। মাঝে মাঝে কলকাতা আসতেন অফিসের কী সব কাজে এবং বেশির ভাগ সময়ে বিনা নোটিসে। বিয়ে করেননি, না হয়ে ওঠেনি, না মা-বাবার ঠিকমত চেষ্টা না করায় বিয়ে হয়নি— সেটা জানা নেই। আমরা যখন ওঁকে দেখেছি, তখন মেট্রন-পিসির বয়স পঞ্চাশের কোঠায়। ভারী কিন্তু টাইট চেহারা। শাড়ি সব সময় পাটপাট, চুল টেনে একটা খোঁপা— কোনও চুলের বাপের ক্ষমতা নেই সেই বাঁধন ভেঙে ক’গাছি কপালের ওপর এসে পড়ে। বাঁ গালে একটা বড় তিল আর সব সময় পাম শু, সঙ্গে গার্ডার দিয়ে হাঁটু অবধি টানটান মোজা। আরও একটা জিনিস ছিল। সে কথায় খানিক পরে এন্টার করাই ভাল।
আমার বন্ধুর বাড়িতে, বন্ধু, তার বাবা, তার মা, তার বাড়ির রান্নার লোক, বাড়ির কেয়ারটেকার মায় কুকুরটা অবধি সবাই একই রকম ভয় করত এই প্রচণ্ড ডিসিপ্লিন্ড পিসিকে। প্রায় লীলা মজুমদারের কোনও কোনও চরিত্রের মতোই ছিলেন তিনি, যাদের একটা বাজখাঁই চেহারার মজার ছবি বইটার গোড়ায় দেওয়া থাকে। সেটা দেখেই আন্দাজ পাওয়া যায়, বাঘ, গরু, এমনকী গাড়োয়ানকেও এক গেলাসে স্ট্র দিয়ে জল খাওয়ানোর ক্ষমতা আছে মহিলার। কিছু দিন আমরা, মোস্ট উড়ুক্কু কলেজবন্ধুর দল, ওদের বাড়ি যাওয়া-আসার পরেই মেট্রন-পিসিকে ভয় করতে শুরু করলাম। এই যেমন কলেজ থেকে ওর বাড়ি গিয়েছি। বেশ ফুরফুরে সাজগোজ করে। হঠাৎ মেট্রন-পিসি উপস্থিত। সঙ্গে সঙ্গে অজান্তেই আমরা হাতের উলটো পিঠে লিপস্টিক মুছে ফেলতাম। কেমন যেন মনে হত, এই রে! নির্ঘাত বকবেন, ‘অ্যাই মেয়েরা, পড়াশোনায় মন নেই, কেবল সাজগোজ!’ তাই রিস্ক নিতাম না। আর মেট্রন-পিসি একটু চোখের আড়াল হলেই সবাই মিলে নিচু গলায় কিন্তু খুব উৎসাহের সঙ্গে ‘কমল মিত্র-র হাফ-ফিমেল ভার্সান’ বলে যা-তা বলতাম, এমনকী ডায়লগ দিয়ে দিয়ে।
একদা এক ভত্তি গরমের দুপুরে আমরা বন্ধুর বাড়িতে জমায়েত। সে দিন কাঠফাটা-চাঁদিফাটা গরম। রাস্তার পিচও শেড খুঁজছে। এমত দিনে আমরা ওদের বাড়ির সব লোককে নিয়ে প্রচণ্ড যা-তা বলছিলাম আর তুমুল হাসি-মশকরা করছিলাম। সে দিন আবার আমার বন্ধুর বেশ কয়েক জন দাদা-দিদিও সেই নিন্দে-পার্টিতে পার্টিসিপেট করেছিল। জমজমাটি আড্ডা যখন তুঙ্গে, তখন কাকুও দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন ঘটনার সন-তারিখ, ঘটনাটি ছোট কাকার বাড়িতে ঘটেছিল কি না কিংবা সিঁড়ি থেকে মেজ পিসিমাই পড়ে গিয়েছিল কি না এ রকম অনেক জরুরি তথ্য ঠিক করে দিচ্ছিলেন। তো, যে গল্পটায় সবাই আমরা পেট চেপে ধরেছিলাম, সেই গল্পের একটা ইম্পর্ট্যান্ট জায়গায় আমার বন্ধু বুঝতেই পারছে না, ভিলেনটা কে। বন্ধুর ছোড়দা তখন হাত-পা নেড়ে বলল, ‘তোর মনে নেই, গোঁফওলা পিসি সামনের দরজায় দাঁড়িয়েছিল বলে আমি আর চিন্টু পেছনের দরজা দিয়ে টুক করে কেটে পড়লাম?’ ঝপাং— সবাই চুপ। কারও মুখে বাক্যি সরছে না। ও দিকে ছোড়দা ফুল ফর্মে, ‘এই তোর মনে আছে, পায়ে গার্ডার দেওয়া মোজা পরে গোঁফওলা পিসি কেমন বাবাকে হাইজিন সম্পর্কে জ্ঞান দিচ্ছিল?’
সম্বিৎ ফিরে পেয়ে আমার বন্ধু হাত-পা চোখ নেড়ে প্রসঙ্গ ঘোরানোর চেষ্টা জুড়ল। আমাদের মুখ কালো। কিন্তু ছোড়দা নাছোড়, একই জায়গায় রেকর্ড কেটে গিয়েছে। আর ও দিকে আমরা তখন ধরণীর কাছে প্রাণপণ কাকুতিমিনতি— প্লিজ স্লাইট ফাঁক হয়ে যাও।
কারণ আমাদের সবাইকে প্যারালাইজ করে দিয়ে ওইখানটায় হঠাৎ উদিত হয়েছেন মেট্রন-পিসি। হইচইয়ের চোটে আমরা দরজা নাড়া শুনতে পাইনি। দরজা বোধহয় মানদা মাসি খুলে দিয়েছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনছেন হাফ কমল মিত্র, গোঁফওলা পিসি! |