চেনা গল্প অচেনা মোচড়
আজ কপাল পুড়ল: দ্য গিফট অব দ্য মেজাই-এর
লার টেনশন শুরু হল বাড়িতে ফেরার পর। তার আগে পর্যন্ত সবই ছিল ঘোর। ভাবার তেমন সময়ও পায়নি। ঘুম থেকে উঠে দেখে ড্রয়ারে ১৮৭ টাকা পড়ে আছে। এটিএম কার্ড-ও খুঁজে পাওয়া গেল না। অবশ্য থাকলেই বা কী, ব্যাংকে আর টাকা আছে কি না সন্দেহ। লোকটার ওপর যে হাড়পিত্তি জ্বলে সে তো আর এমনি না। লোকে বলে প্রেম। কিন্তু খালি পেটে প্রেম হয়? গত দু’বছরে জানলার পরদা বদলানো হয়নি। রংচটা বিছানার চাদর। তোশক ছিঁড়ে যে কোনও দিন বেরিয়ে আসবে নাড়িভুঁড়ি। টাকাপয়সা মাসের কুড়ি তারিখ হতেই খতম। এ ভাবে কি সত্যিই বেশি দিন কাটানো যায়?
চার দিকে শুধু নেই নেই নেই। নিজেকে আবর্জনার ইঁদুর মনে হয়। সবটাই যে জয়ের অমনোযোগের কারণে তা নয়, কিন্তু রাগ আর কার ওপরেই বা করবে? মাথা ঠান্ডা রাখতে তার পরে অবশ্য রিহার্সাল দিয়েছে অনেক বার, কী ভাবে কথাটা বলবে। তখনও কোনও টেনশন ছিল না। এ সব তো কত আগেই ঠিক করে রাখা, আজ, ২৪ ডিসেম্বর শুধু স্টেজ রিহার্সাল। পার্লারে বসেও পলা বিড়বিড় করছিল তার মুখস্থ করে রাখা ডায়ালগ। চোখ বুজে। যে মেয়েটি চুল কাটছিল, সে বলেছিল, কষ্ট হচ্ছে? না। বলেছিল পলা। আসলে সত্যিই কষ্ট নয়, চোখ বুজে সে শুনেছিল মহীরুহ পতনের শব্দ। এই কোমর-ছাপানো ঘন চুলে হাত দেবার অছিলায় জয় আর কখনও ছুঁয়ে দেবে না তার ঘাড়। কখনও না। নিজেরই সিদ্ধান্ত, তবু মেনে নেওয়া, হায়, মেনে নেওয়া কঠিন।
বাড়ি পৌঁছতে বিকেল। তখনও কোনও উৎকণ্ঠা ছিল না। সব শান্ত। ঝড়ের আগে যেমন হয়। মাথাটা ভোঁতা। দরজা খুলতেই বুকটা কেমন ছ্যাঁৎ করে ওঠে। টেবিলের ওপর অকেজো টিভি। নোংরা আয়নায় হাতের ছাপ। গলায় কাটার দাগটা চুল কাটার পর স্পষ্ট। শুকিয়ে কালো হয়ে এসেছে। এ সব কালকের আঁচড়াকামড়ির ফল। জয় ধাক্কা মেরেছিল। কাল না কি পরশু? হিসেবও থাকে না আজকাল। জয়ের গালের আঁচড়টা— সেটাও কি শুকিয়ে এসেছে? দেখাও হয়নি। সেটা জয়ের জীবনে পলার এই সপ্তাহের অবদান। নাহ্, মনোযোগ অন্য দিকে নিয়ে যেতে হবে। পলা আয়নার দিকে তাকায়। আঃ! নতুন এক নারী দিবস দেখা যায় দিগন্তে। মাশরুম চুলে, সে দেখতে পায়, ভেঙেচুরে যাচ্ছে পুরনো সব বহুতল। এই ঘর, এই ম্যাড়মেড়ে সোফা, এই নোংরা ক্যাবিনেট, এ সব মহাশূন্যে বিলীয়মান। আর জয়? ভাবতেই কী সব অলক্ষুনে সুখস্মৃতি মনে আসে চুল আর জয়কে জড়িয়ে। আর ঠিক সেই সময়ই ঝাঁপ মারে টেনশন। এ তো ঠিক রোজকারের কুকুরসুলভ চুলোচুলি না। এত বড় ব্যাপারটা জয় বুঝবে তো? পলা বোঝাতে পারবে তো? মুখে যদি সব বোঝাতে না পারে?
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী
ঘড়ি দেখে পলা। জয়ের ফিরতে এখনও আধ ঘণ্টা। তার পর কাগজ-কলম টেনে লিখতে বসে। কোনও ঝুঁকি নেওয়া ঠিক না। বুক ধড়ফড় করে। সেই প্রথম দিনের প্রেমপত্র লেখার মতো। ‘তোমার খোঁপায় বেন্ধে দিব লাল গ্যাঁদা ফুল’— জয় লিখেছিল। সে নিয়ে কী হাসাহাসি। উহ্, আবার সুখস্মৃতি। বুক ধড়ফড় নিয়েই লিখতে থাকে পলা। জয় নিশ্চয়ই বুঝবে, মানুষকে কোনও না কোনও সময়ে এ রকম কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেই হয়। সেটা জুলুম নয়। অপারগতা।
চিঠি শেষ। পাঁচটা পঁয়ত্রিশ। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ হয়। নাহ্, এত হালকা পায়ে জয় হাঁটে না। তবু এক বার উঁকি মেরে দেখে। লম্বা চুলের পাতলা একটা মেয়ে। লাল জামা পরা। এখানে থাকে নাকি? যাগ্গে। জেনে কী লাভ? চিঠিটা দরজার ঠিক সামনে ক্যাবিনেটের উপর রেখে দেয় পলা। চিঠির ওপরে লেখা— জয়কে। তার পর রান্নাঘরে গিয়ে অকারণেই এক মুঠো চিপ্স মুখে ফেলে দেয়। বাথরুমে গিয়ে জোরে খুলে দেয় ট্যাপ ওয়াটার। মুখে-চোখে জল দেয়। দিতেই থাকে।
খুট করে একটা শব্দ পেয়ে যখন সে দরজা খোলে, তখন দেরি হয়ে গেছে। ঘরে জয়। কখন এল? শব্দই বা পাওয়া যায়নি কেন? প্রাচীন ভাস্কর্যের মতো স্থির। চিত্রার্পিত। চিঠি কি আগেই পড়ে ফেলেছে? হ্যাঁ, কাগজটা ভাঁজখোলা। কত ক্ষণ বাথরুমে ছিল পলা, কত ক্ষণ?
যা বলার জন্য এত দিনের প্রস্তুতি তা আর বলা হল না। একটু স্বস্তিও কি পায় না পলা? জয়...বলে সে। গলা তার বুজে আসে। জয় তখনও পাথরের মতো দাঁড়িয়ে। পলা তার জামার হাতা ধরে নাড়া দেয়। আমি সরি।
জয় নড়ে না। অনেক অনেক দিন ধরে বলব ভাবছি, বলে পলা। এ ভাবে আমি পারছি না জয়। এ ভাবে হয় না। আমারও তো একটা জীবন আছে।
জয় তখনও চুপ করে দাঁড়িয়ে। জয়। বলে পলা। এ রকম করে থেকো না। প্লিজ। রাগো। চেঁচাও। মারো। কিছু করো। মানুষ অন্যের প্রেমে পড়ে কখনও গল্পেও পড়োনি? জয়কে জোরে জোরে ঝাঁকাতে থাকে সে।
ঝাঁকানিতেই কিনা কে জানে, জয় হঠাৎই স্বাভাবিক মানুষের মতো নড়ে ওঠে। একটু বেশিই স্বাভাবিক। যেন ঘুম ভেঙে উঠল। তার পর খুব শান্ত গলায় পলাকে বলে, ঠিক আছে পলা। এত শান্ত জয়কে বহু দিন দেখেনি পলা। হ্যাঁ। এ সব গল্পে পড়েছি। কিন্তু ঠিক সে জন্য...
বলতে বলতেই দরজার দিকে পায়ে পায়ে এগোয় জয়। চলে যাচ্ছে? শেষ বারের মতো জয়ের চওড়া পিঠ দু’চোখ ভরে দেখে নেয় পলা। কিন্তু ‘সে জন্য’ কী? যাওয়ার আগে বলে যাও।
জয় উত্তর দেয় না কোনও। দরজা খোলে আস্তে করে। তার পর কাকে যেন বলে, এসো।
কে আসবে? কোথায়? দরজার পাশের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে পলা। আর দেখে, খোলা দরজা দিয়ে ঘরে ঢোকে সেই লম্বা চুলের লাল জামা পরা মেয়েটা। পলা যাকে এই একটু আগেই দেখেছে। এ কে? এ কেন? আসলে— জয় পলার কাঁধে হাত রেখে বলে— আমি আজকেই তোমাকে বলতাম। রানির কথা।
পলা সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে যায়। তার পর হঠাৎই জয়ের হাত তুলে নিয়ে চুমু খায় আদিম মানবীর মতো। চোখে যদিও জল। আজ থেকে বহু শতাব্দী আগে মেরি নামক একটা মেয়ের জন্য প্রাচ্য দেশের জ্ঞানীরা বহু মহামূল্যবান উপহার এনেছিলেন। সে উপহার, যতই মহার্ঘ হোক, তাতে এতটা স্বস্তি ছিল না।
সে বড়দিনটা ওদের চার জনেরই খুব ভাল কেটেছিল।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.