|
|
|
|
|
|
|
সুমনামি
কবীর সুমন |
দুনিয়া পরিবর্তনশীল। এক কালে শুনতাম ‘পল্লিগীতি’। এখন শুনি ‘লোকগীতি’। বাংলাদেশে, যেখানে পল্লিসংগীতে পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে বেশি বৈচিত্র, এখনও সম্ভবত ‘পল্লিগীতি’ কথাটাই বেশি বলে লোকে। গত দু’তিন দশকে পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলাদেশে বাংলা ব্যান্ড বা বাংলা রক্ ব্যান্ড বাংলার কিছু কিছু পল্লিগীতি আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে সোৎসাহে পরিবেশন, এমনকী রেকর্ডও করেছেন। তাতে রিদম গিটার, বেস গিটার, ড্রাম্স ইত্যাদি বেজেছে। বিশুদ্ধতাবাদীরা হয়তো আপত্তি তুলবেন, কিন্তু প্রত্যেক যুগ তার আগের যুগের সংগীতকে নতুন করে আবিষ্কার করে নিতে চাইবে— এটাই স্বাভাবিক। এক সময়ে খেয়াল-গায়কেরা শুধু তানপুরা, তবলা, সারেঙ্গি ও হারমোনিয়ামের সঙ্গতে গান গাইতেন। পঞ্চাশের দশকে আমরা দেখলাম শুনলাম আচার্য বড়ে গুলাম আলি খান খেয়াল ও ঠুংরি গাইছেন স্বরমণ্ডল যন্ত্রটি বাজিয়ে— তানপুরা, তবলা, সারেঙ্গি অবশ্যই আছে। আচার্য ফৈয়াজ খান সাহেব কিন্তু স্বরমণ্ডল বাজাননি। কারও কারও মতে খেয়াল আঙ্গিকের যিনি শেষ কথা, সেই আচার্য আমীর খানও স্বরমণ্ডল নিতেন না। কত বড় বড় খেয়ালশিল্পী স্বরমণ্ডল নিচ্ছেন না, কিন্তু ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খান নিচ্ছেন, পাকিস্তানের তুখড় ভ্রাতৃদ্বয় ওস্তাদ সালামাত আলি খান ও নাজাকাত আলি খান নিচ্ছেন, অতএব স্বরমণ্ডল ব্যবহারকারীরা জাত খোয়ালেন— এমন কথা কেউ কখনও বলেননি উপমহাদেশে। বরং কণ্ঠশিল্পী যে রাগটি গাইছেন, সেই রাগের পরদাগুলিতে বাঁধা স্বরমণ্ডল গোটা পরিবেশনার একটি শ্রুতিসুখকর পটভূমি রচনা করত, এখনও করে থাকে, তাই স্বরমণ্ডলের পরিমিত প্রয়োগ ভালই লাগে। মনে আছে, আমার প্রথম যৌবনে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের একটি অনুষ্ঠানে আচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের গাওয়া খেয়ালের সঙ্গে স্বরমণ্ডলের প্রয়োগ। সংগীতের প্রয়োগপদ্ধতি নিয়ে সমানে মাথা ঘামিয়ে যাওয়া এই জিনিয়াস সেই অনুষ্ঠানে যন্ত্রটিকে অসামান্য ব্যবহার করেছিলেন। কয়েকটি মোক্ষম জায়গায় তিনি স্বরমণ্ডলের সাহায্যে স্বরসংগীত (হারমোনি) সৃষ্টি করছিলেন। স্বরমণ্ডলের পরিকল্পিত ও পরিমিত প্রয়োগে চিরকালের মতো বিশিষ্ট হয়ে আছে নির্মলা অরুণ ও লক্ষ্মীশঙ্করের দ্বৈত কণ্ঠে গাওয়া ঠুংরির গ্রামোফোন রেকর্ড। কাজেই বাংলার পল্লিগীতিতে একুস্টিক গিটারের প্রয়োগ মেজাজমাফিক ও পরিমিত হলে বেমানান হবে কেন?
বাংলার যাত্রায় ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই বেহালা, ক্ল্যারিনেট (আমাদের দেশে প্রায় সকলেই ‘ক্ল্যারিয়োনেট’ বলে থাকে), কর্নেট ব্যবহার করা হয়ে আসছে। একটিও দিশি যন্ত্র নয়। এই যন্ত্রগুলি দিয়ে যে-সব সুর বাজানো হত, সেগুলি কিন্তু দিশি। এ ব্যাপারে বাঙালির কোনও ছুঁৎমার্গ ছিল না। যন্ত্রের ব্যাপারে ছুঁৎমার্গ দেখা দেয় বরং রবীন্দ্র-পরবর্তী আমলে। হারমোনিয়াম যন্ত্রটি নিয়েই যে নাটক নাগরিক, শিক্ষিত বাঙালি করেছে, তার তুলনা নেই। রবীন্দ্রনাথ নাকি হারমোনিয়ামের বিরোধী ছিলেন, অতএব তাঁর গানের সঙ্গে এবং বেতারে হারমোনিয়াম চলবে না। ফলে ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, দিলীপকুমার রায়, শচীন দেব বর্মনের মতো শিল্পীরা বেতারে গান গাওয়া ছেড়ে দিলেন। এঁরা হারমোনিয়াম ছাড়া গান গাইতেন না। ভীষ্মদেব এমনকী খেয়ালও গাইতেন হারমোনিয়াম বাজিয়ে।
|
|
ছবি: সুমন চৌধুরী |
ষাটের দশকে আকাশবাণীর এক্তিয়ারে শুরু হয় হারমোনিয়াম-বিতর্ক। বেতারে হারমোনিয়াম চালু করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন আচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, সলিল চৌধুরী সমেত আরও কেউ কেউ। বিপক্ষেও ছিলেন জোরালো সব বক্তা। পক্ষ-অবলম্বনকারী এক জন বলেছিলেন, ‘বড় বড় কণ্ঠশিল্পী হারমোনিয়ামের সঙ্গত ছাড়া রাগসংগীতের আসরে বসেনই না।’ জবাবে বিপক্ষের এক বক্তা বলেছিলেন, ‘স্বামী বিবেকানন্দ ধূমপান করতেন মানে এই নয় যে ধূমপান একটা ভাল অভ্যাস।’
বিতর্কে কিন্তু হারমোনিয়ামপন্থীরাই জিতে যান। শুধু তাই নয়, এই মুহূর্তে আমার ঠিক মনে পড়ছে না কোন সালে, কোন তারিখে, কোন পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের লেখা একটি চিঠি কেউ ছাপিয়ে দেন অথবা রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে কেউ লেখেন যে, শেষ দিকে রবীন্দ্রনাথ নিজেই একটি হারমোনিয়াম কেনার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। ব্যস, ল্যাঠা চুকে গেল। হারমোনিয়াম যন্ত্রটিকে আর ব্রাত্য রাখা গেল না। ১৯৫৮ সাল থেকে প্রথমে শিশুমহল, তার পরে গল্পদাদুর আসর এবং ১৯৬৭ সাল থেকে বড়দের অনুষ্ঠানে আকাশবাণী কলকাতা থেকে রবীন্দ্রসংগীত ও আধুনিক বাংলা গান গাওয়া এই আমি কখনও হারমোনিয়াম বাজতে দেখিনি আকাশবাণীর কোনও অনুষ্ঠানে। সেই আমি ১৯৭১ সালে প্রথম দেখলাম, শুনলাম আকাশবাণীর স্টুডিয়োয় হারমোনিয়াম বাজছে। নিতান্ত কপালজোরে পঙ্কজ কুমার মল্লিকের পরিচালনায় সরস্বতীপুজো উপলক্ষে একটি বিশেষ সংগীতানুষ্ঠানে গান গাওয়ার সুযোগ পেয়ে গেলাম। বাণীকুমারের লেখা গান, পঙ্কজ কুমার মল্লিকের সুর। সংগীত পরিচালনায় তিনি নিজে। সেই অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং-এ হারমোনিয়াম বাজালেন অলোকনাথ দে, যাঁর মতো উদ্ভাবনশীল ও সৃষ্টিশীল যন্ত্রশিল্পী পৃথিবীতে খুব কমই জন্মেছেন। জীবনে আর কিছু না হোক, এক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী থাকলাম। এই পৃথিবীতে অনেক দারুণ দারুণ জিনিস আবার হবে, কিন্তু আর এক জন অলোকনাথ দে হবে না কোনও দিন।
সেই সময়ে নিয়ম ছিল কেবল এ-গ্রেড কণ্ঠশিল্পীদের গানের সঙ্গে হারমোনিয়াম বাজবে। দেবব্রত বিশ্বাসের গান শোনা গেল এক দিন— হারমোনিয়াম সহযোগে। তাঁর কণ্ঠের অতুলনীয় ‘ব্যারিটোন’ ও মাঝে মাঝে ‘বেস’ (bass) ধ্বনির সঙ্গে তাঁর পরিমিত ভাবে বাজানো হারমোনিয়মের ‘ট্রেবল্’ মিশে তৈরি হল নিটোল সাংগীতিক অভিজ্ঞতা।
এই দেবব্রত বিশ্বাসের গ্রামোফোন রেকর্ডিং-এ যন্ত্রসংগীত প্রয়োগে ‘বাড়াবাড়ি’র কথা তুলে বিশ্বভারতী সংগীত বোর্ড এক সময়ে তাঁর একটি রেকর্ডিং অনুমোদন করলেন না। তার আগে কিন্তু তাঁর বেশ কয়েকটি রেকর্ডিং অনুমোদিত হয়ে বাজারে বেরিয়েছে। আমার ধারণা, আকস্মিক আপত্তির পেছনে কোনও শক্তিশালী ব্যক্তির হাত ছিল। আপত্তির কারণটা সংগীতভিত্তিক ছিল বলে মনে হয় না, ব্যক্তিগত রেষারেষিই হয়তো ছিল আসল কারণ।
এর তিন দশক পর এই অধম শুধুমাত্র একটি একুস্টিক গিটারের সঙ্গতে পাঁচটি রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড করেছিল এবং বিশ্বভারতী সংগীত বোর্ড তা অনুমোদনও করেছিল। রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ডিং-এর ইতিহাসে সেই প্রথম কেবলমাত্র একটি একুস্টিক গিটারের সঙ্গতে গাওয়া রবীন্দ্রনাথের গান বিশ্বভারতীর অনুমোদনে প্রকাশিত হল।
সময়। সময়ে অনেক পরিবর্তন হয়। বাংলার পল্লিগীতির সঙ্গে অতীতে যে যন্ত্রগুলি বাজত, সেগুলির সঙ্গে আজ যদি নতুন কোনও যন্ত্র— যেমন, গিটার বা কিছু তালযন্ত্র, গানের মেজাজ ও চরিত্র বজায় রেখে বাজানো যায় তো জাত যাবে বলে মনে হয় না। খেয়াল রাখা দরকার, যাঁরা বাজাচ্ছেন ও গাইছেন, তাঁরা যেন সংগীতে প্রশিক্ষিত হন, তাঁরা যেন অনুগ্রহ করে অতীতের রেকর্ডিংগুলি শোনেন এবং তা থেকে শেখেন। বাংলা গান এমন কোনও অপরাধ করেনি যে অশিক্ষা ও অপটুত্বকেই সম্বল করে এ ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়ে জগৎ উদ্ধার করতেই হবে। |
|
|
|
|
|