প্রবন্ধ...
আঙুল তোলো, ঠিক আঙুল
লফ করে বলতে পারি মানুষমাত্রেরই (আপনি না) অন্যের ঘাড় ভীষণ প্রিয়। কারণ দোষ চাপানোর এমন প্রকৃষ্ট জায়গা আকাশ-পাতাল এক করলেও মিলবে না। নিজের দায় থাকলেও আমরা চটপট তা অন্যের দিকে খুব দ্রুত পাস করে দিই আর নিজে ভিকটিম সেজে স্বস্তি পাই। শুনতে খারাপ লাগলেও এটারই একটা বড় আকার হল বিয়ের মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাসকে ধর্ষণ বলে চিহ্নিত করা। সেই সহবাসে মেয়েটিও স্ব-কামনায় জড়িত ছিল, কারণ তা না হলে তো তখনই সেটা ধর্ষণ বলে চিহ্নিত হত, অর্থাৎ তখন তা ছিল একটি স্বাভাবিক সম্পর্কের অঙ্গ, একটা ভাল-লাগার আবেশও ছিল তাতে। কিন্তু যেই বিয়েটা হল না, চটজলদি ওই সহবাসটি ধর্ষণে রূপান্তরিত হল। পুরুষটি ধর্ষক, মেয়েটি ধর্ষিতা, অর্থাৎ ভিকটিম।
ভাল মেয়ে থেকে ধর্ষিতা হলাম, দোষটা চাপিয়ে দিলাম পুরুষের ঘাড়ে।
এই ধরনের এক ঘটনার প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট কিছু দিন আগে রায় দিয়েছেন যে, বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাস মানেই তাকে ধর্ষণ বলে অভিযোগ করা যাবে না। ‘মিথ্যে প্রতিশ্রুতি’ আর প্রতিশ্রুতি রাখতে না পারার মধ্যে ফারাক করতে হবে। অর্থাৎ, কেউ কেবল যৌনতা চরিতার্থ করার জন্যই বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, আর কেউ সত্যি বিয়ে করতে চেয়েছিল কিন্তু কোনও কারণে সম্ভব হয়নি এই দুটো ঘটনা আলাদা, তাদের আলাদা করেই দেখতে হবে।
ঠিকই তো। কোনও ছেলে যদি কথা দেয় যে বিয়ে করব, তার মানে এই নয় যে সে কেবল যৌনতা করতে চায় বলেই কথা দিয়েছে। হতেই পারে, কোনও কারণে সে বিয়ে করতে পারল না। আবার এ-ও হতে পারে যে, মাস ছয়েক বাদে তার এই সম্পর্কটা আর ভাল লাগল না। ছ’মাস বাদে ভাল লাগল না মানে প্রথম থেকে ভাল লাগেনি, এমনটা তো জোর দিয়ে বলা যাবে না। আর এখন ভাল লাগছে না বলে ওই ছ’মাসের প্রতিটি যৌনতার দিন অসৎ, এ কথাই বা কে বলল? কে বিধান দিয়ে দিল যে, ওই সময়ের প্রতিটি যৌনতার ঘটনা আসলে ধর্ষণ।
নিশ্চয়ই, এই বিয়ের প্রতিশ্রুতি না রাখার মধ্যে যেটা দগদগে ঘা হয়ে যন্ত্রণা দিচ্ছে, সেটা হল বিশ্বাসভঙ্গ। যদিও, কেউ যৌনতা চরিতার্থ করার জন্যই বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকলে, সেই প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করার একটা দায় কিন্তু মেয়েটির ওপরও বর্তায়। মেয়েটিকেও বুঝতে হবে যে বিয়ে করবে বলছে মানেই বিয়ে করতে বাধ্য এমনটা নয়। বিয়ে না-ই হতে পারে, এ সম্ভাবনাও আছে। তবু, যদি ছেলেটি টনটনে জ্ঞানে বিশ্বাসে কোপ মেরে থাকে, সেটা আলবাত অপরাধ। কিন্তু সে ক্ষেত্রে তাকে প্রতারণার দায়ে ধরতে হবে, ধর্ষণের দায়ে নয়। প্রতারণা আর ধর্ষণ এক নয়। যে সহবাসের সময় মেয়েটির সম্মতি ছিল, বিয়ে না করার দরুন সেই সহবাস অসম্মতির অভিজ্ঞান দেখাবে কী করে? তার মানে, সারা জীবন একটা পুরুষের সঙ্গে কাটানোর যে ইচ্ছে, সেটা কেবল বিয়ের জন্যে? বিয়ে হবে বললে অনিচ্ছেটা ইচ্ছেতে বদলে যায়, আর হবে না বললেই সহবাসটা ধর্ষণ হয়ে যায়? এ যুক্তি জজে মানবে না, আর তাই মানেওনি।
সব কেসকে একধারসে প্রতারণা বলা যাবেই বা কী করে? প্রতারণা তো অসততার ও-পিঠ। কেউ যদি কোনও সম্পর্কে একশো ভাগ সৎ থাকতে চায়, তা হলে সে ভাল-লাগাকে যেমন মূল্য দেবে, ভাল-না-লাগাকেও তো তেমনই সম্মান করবে। কেউ যদি একটা সম্পর্কের প্রতি অন্তরে সৎ না থেকেও বিয়েটা করে নেয়, স্রেফ এক দিন কথা দিয়ে ফেলেছিল বলেই বিয়ে করে নেয়, তা হলেই সে ভাল এবং বিশ্বাসযোগ্য? কিন্তু কত বড় অসততা সে নিজের মনের সঙ্গে করছে! মেয়েটির মনের সঙ্গেও! সম্ভবত মেয়েটির সঙ্গে অত্যন্ত অনীহায় প্রতিটি দিন কাটাচ্ছে এবং প্রতি রাতে অপ্রেম নিয়ে যৌনতা করছে। সেটা বিশ্বাসভঙ্গ নয়? প্রতারণা নয়? সেটা তো বরং আরও বেশি ধর্ষণ!
এই অভিযোগের মধ্যে আরও একটা ইঙ্গিত আছে। যেন, যৌনতার ক্ষেত্রে, মেয়েটি দাতা ও পুরুষটি গ্রহীতা। যেন, মেয়েটি আনন্দ ‘দিল’, ছেলেটি তা ‘পেল’। তাই, বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মেয়েটির কাছ থেকে সে সর্বস্ব ‘নিয়ে নিয়েছে’, মেয়েটি ‘দিয়ে, ঠকেছে’। কেন? মেয়েটিও তো নিয়েছে। সমানে সমানে যৌন আনন্দ নিয়েছে। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছেলেটি যে-সহবাস করেছে, মেয়েটিও সেই সহবাসটা অসম্ভব পুলকে করেছে। সেই লাভটাকে শুধুই লোকসান বলে দেখানো হচ্ছে কেন? ছেলেটি মেয়েটির সব নিয়েছে, মেয়েটিও ছেলেটির সব নিয়েছে। ব্যাপারটা ফিফটি-ফিফটি হয়ে মিটে যাচ্ছে না কেন?
আসলে চিড়বিড়িনিটা অন্য জায়গায়। ভারতে তো বিয়ের আগে মেয়েদের যৌনতার লাইসেন্স নেই। তাই মেয়ে, তুমি এ কাজ করলে কী করে? নিজের ইচ্ছায়, নিজের যৌনতা চরিতার্থ করলে কী করে? তোমার যোনি তখনই আনন্দের অধিকারী, যখন সমাজ বিয়ের সিলমোহর দেবে। তোমার শরীর তো বিয়ের আগে ঘামে-তেলে লালায়িত হতে পারে না কোনও পুরুষের জন্য। হলেও, অন্তত বিয়ের আগাম চুক্তি চাই, তা হলে সহবাস একটা লাইসেন্স পেতে পারে, অ্যান্টিসিপেটরি লাইসেন্স। বিয়ে না হলে লাইসেন্স বাতিল। তাই, যদি তুমি যৌনতার আনন্দ পেয়েও থাকো এবং তার পর বিয়েটা না হয়, তবে খবরদার সে কথা গলা বাড়িয়ে বোলো না। কারণ সমাজে তোমার মূল্য থাকবে না। তোমার যৌন-কামনার কোনও দর নেই। আর তাই, হে পিতৃতন্ত্রের প্রোডাক্ট, বিয়েবিহীন যৌনতার আনন্দজনিত দোষ খণ্ডাতে তুমি বলো যে তুমি ধর্ষিতা। তাতে তোমার আনন্দে খলবলিয়ে ওঠার অধিকার খর্ব হল তো কী হয়েছে, তুমি সমাজের অঙ্গুলিহেলনে চললে তো কী হয়েছে, তুমি নিজের আত্মসম্মান গঙ্গায় টিপ করে ডুবিয়ে দিলে তো কী হয়েছে তুমি সমাজের কাছে সেফ থাকলে, সাফ থাকলে, নিজের যৌনতার দায় তোমায় নিতে হল না।
অঙ্কটা কি এতই সহজ? আর যে যা-ই বলুক, মেয়ে, তুমি এত সহজে ধর্ষণ বোলো না। তুমি তো জানো, অন্তত মেয়ে হওয়ার বোধ থেকে তো নিশ্চয়ই বুঝতে পারো যে, ধর্ষণ কথাটার মধ্যে কতখানি অনিচ্ছা, জোর, কষ্ট, ব্যথা, ঔদ্ধত্য, নিষ্ঠুরতা রয়েছে! তুমি তো জানো মেয়ে যে, ধর্ষণ এত তুচ্ছ নয়। যেই বিয়েটা উঠে গেল অমনি সহবাসটা ধর্ষণ হয়ে গেল এতে কে সবচেয়ে অপমানিত হল? মেয়েরা। আর কে অপমান করল? মেয়ে, তুমি। তুমি নিজেকে এতটা অপমান করতে পারলে? সমাজে তোমায় খারাপ মেয়ে বলে দেখা হবে বলে নিজের সত্তাকে অস্বীকার করলে? নিজের সম্মানকে, নিজের কামনাকে জলাঞ্জলি দিয়ে গলা মিলিয়ে বললে, ‘ও আমায় ধর্ষণ করেছে?’ ও যে তোমায় আগে কতখানি আনন্দের ভাগীদার করেছে সেটা ভুলে গিয়ে নিজেকে অপমান করলে আর অন্যকে অপমান করার অধিকার দিলে! এক বারও কলার তুলে বলতে পারলে না যে, হ্যাঁ আমি যৌনতা করেছি, বেশ করেছি, আমি সে জন্য লজ্জিত নই, অনুতপ্তও নেই। সাবালিকা হও মেয়ে, বলো, আমি যৌনতা ভালবাসি। বলো, আমি প্রতারণা মানতে পারছি না, আমি বিশ্বাসঘাতকতা মানতে পারছি না, ও আমায় তুচ্ছ করেছে, অপমান করেছে সেটা মানতে পারছি না, কিন্তু আমি ধর্ষিতা হইনি, নিজেকে ধর্ষিতা হতে দিইনি।
এ বলার সাহস যে দিন পাবে, সে দিন যৌনতাকে ধর্ষণের মোড়কে মুড়ে নিজের দোষ ঢাকতে হবে না।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.