সমাধিস্থলে গিয়া সর্ব ক্ষণ বসিয়া থাকেন গ্রাহাম। কারণ, তাঁহার বদ্ধমূল ধারণা, তিনি মৃত, অতএব কবরখানাই তাঁহার উপযুক্ত স্থান। প্রথম এই অনুভূতি তাঁহাকে যখন গ্রাস করে, তিনি খাদ্যগ্রহণ ছাড়িয়া দেন, দাঁত মাজিতেন না, স্নান করিতেন না, কাহারও সহিত কথাও বলিতেন না। কারণ মৃতেরা তো এইগুলি করে না। নয় বৎসর ধরিয়া বহু চিকিৎসার পর তিনি কিঞ্চিৎ বিশ্বাস করিতেছেন তিনি জীবিত। এটি এক বিরল অসুখ, নাম ‘কোটার্ড’স সিন্ড্রোম’। এই অসুখে আক্রান্ত অন্য এক রোগী ক্রমাগত অনুরোধ করিতেন, তাঁহাকে যেন মর্গে লইয়া যাওয়া হয়, নিজ দেহ হইতে মৃতের দুর্গন্ধ অসহ্য বোধ হইতেছে। চিকিৎসা না হইলে এই অসুখে রোগী অনাহারেই মরিয়া যায়। গ্রাহামের চিকিৎসকরা তাঁহার মস্তিষ্কের স্ক্যান করিয়া দেখেন, নিদ্রাকালীন, বা অজ্ঞান হইয়া যাইলে মানুষের মস্তিষ্কের কিছু অংশ যেই রূপ নিষ্ক্রিয় হইয়া যায়, গ্রাহামের মস্তিষ্কের ওই অংশগুলি সেই রূপই নিষ্ক্রিয়।
মৃত্যু বলিতে আমরা বুঝি শরীর ও চৈতন্যের লোপ। আশ্চর্য হইল, এই মানুষগুলি চৈতন্য দিয়াই অনুভব করিতেছেন, তাঁহারা মৃত। চৈতন্য দিয়া যুক্তিবিন্যাস করিয়া সিদ্ধান্ত লইতেছেন, যদি মরিয়াই গিয়া থাকি, তবে খাইব কেন, তেল মাখিব কেন। এই আর্ত-ভঙ্গি যেন এক উদ্ভট দেকার্ত-ভঙ্গি: আমি মৃত, অতএব আমি আছি। অথচ মৃত্যু অর্থে যদি পূর্ণ নাস্তি হয়, তাহা হইলে মৃত কেন তর্ক করিবে, পছন্দানুযায়ী সমাধিস্থলে যাইবে, সর্বোপরি, আদৌ অনুভব করিতে পারিবে যে সে মৃত? বিচারধারার এই ভ্রান্তি রোগীরা নজর করিতেছেন না। কিন্তু তাঁহারা উত্তরে বলিতে পারেন, কে নিশ্চিত ভাবে নিরূপণ করিল, মৃত্যু-পরবর্তী অবস্থায় চৈতন্য লোপ পাইবে? এক খ্যাত চলচ্চিত্রে বিবৃত হয়, মৃত্যুর পর মৃতের নিকট তাহার বাস্তবতার এতটুকু বদল ঘটে না, সে নিজ শহরে, চেনা পথেই দিব্য ঘুরিয়া বেড়ায় ও অনন্ত কাল একই দোকান হইতে রুটি কিনিয়া বাড়ি ফেরে, দৈনন্দিনতার বৃত্তটি বারে বারে ঘুরিয়া একই বিন্দুতে ফিরিয়া আসিতেছে, বুঝিয়া উঠে না। এই রূপকাশ্রয়ী কাহিনির ন্যায় হয়তো সত্যই মৃত্যু-পরবর্তী চৈতন্য কুহক-বন্দি। সেই দৈব হেঁয়ালি যাঁহারা ভেদ করিতে পারেন, তাঁহারা বুঝেন, জীবিত অবস্থাটি বাহ্যিক ভাবে অটুট রহিলেও, তাহার মূল সার নিশ্চিহ্ন। তাই এই অসুখের রোগীগণকে আলপিন দিয়া খুঁচাইলে তাঁহারা ‘উঃ’ বলিয়া উঠিবেন, কিন্তু যুক্তি দিয়া ইঁহাদেরকে বিশ্বাস করানো কঠিন, তাঁহারা বাঁচিয়া আছেন।
আর একটি প্রণিধানযোগ্য দিক: মস্তিষ্কের আত্মসম্মোহনের ক্ষমতা। মানুষের মস্তিষ্ক তাঁহাকে বুঝাইতে পারে, তিনি আকাশ হইতে ধারাবিবরণী শুনিতেছেন। সে মানুষকে ক্রমাগত ফুসলাইয়া উপলব্ধি করাইতে পারে, তিনি পিছু ফিরিলেই তিনটি আততায়ীকে দেখিতেছেন। এই রোগটির ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক স্বয়ং মস্তিষ্কের কিছু অংশের বিরুদ্ধে যাইয়া, তাহাদের কার্য স্তব্ধ করিতেছে! ইচ্ছাশক্তি প্রাণপণ চেষ্টা করিয়া ইচ্ছাশক্তির হ্রাস করিতেছে! তাই চলাফেরা করিবার সময়ও মস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ নিদ্রিত রহিয়াছে। হয়তো মৃত্যু-প্রত্যয়ের ঝাঁঝে, ইহাদের ক্ষমতা শুকাইয়া গিয়াছে। নিজেকে মৃত ভাবিবার সুবিধার্থে তাহাদের ছুটি দেওয়া হইয়াছে। আত্মপরামর্শের প্রভাব কী প্রবল, আত্মধ্বংসের পরামর্শও কী অনুপুঙ্খে পালন করে মানুষের মস্তিষ্ক, ভাবিলে বিস্ময়ের অবধি থাকে না। বাহির হইতে যুক্তি, উপদেশ, ব্যাখ্যা বা আলোচনা দ্বারা এই স্ব-প্রত্যাহারকে নিরস্ত করা অতি কষ্টসাধ্য। রোগী তো বলিয়া উঠিতে পারেন, ‘মরিয়া গিয়াছি, আর তর্ক করিব না!’ |