|
|
|
|
|
|
|
মুখোমুখি... |
|
দাবাং দেখেছি সাত বার |
খোলা শার্টের সলমন তাঁকে মুগ্ধ করে। বাঙালি নারীর চোখ উদাস করে দেয়। ফুটবল কোচ নয়,
এ এক অন্য ট্রেভর জেমস মর্গ্যান।
শহর কলকাতাকে বিদায় জানানোর আগে পত্রিকার
সঙ্গে খোলামেলা আড্ডায়। সাক্ষী দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় |
পত্রিকা: আপনার ছাত্ররা বলে ঘড়ির কাঁটা ধরে কাজ করাটা না কি আপনার জীবনের অন্যতম একটা ট্রেডমার্ক?
মর্গ্যান: ট্রেডমার্ক কি না তা বলতে পারব না। তবে পেশাদার জীবনে এটা দরকার। না হলে পারফরম্যান্স গ্রাফ তো পড়বেই। জটিলতা বাড়বে। ফুটবলার এবং কোচিং জীবনে এটাই আমার এগিয়ে যাওয়ার মূলমন্ত্র বলতে পারেন।
পত্রিকা: আবেগ বলে কোনও ব্যাপার কি আপনার জীবনের অভিধানে লেখা নেই?
মর্গ্যান: কে বলল?
পত্রিকা: গত ছত্রিশ মাসে আপনাকে দেখার পর তো এটাই মনে হয়েছে বারবার।
মর্গ্যান: ধুস্! তা হলে আমাকে আপনারা চিনতেই পারেননি। এটা ঠিক কলকাতার মানুষের মতো এত ডুবুডুবু আবেগ আমার নেই। থাকা উচিতও নয়। জর্জ বেস্ট একবার আমাকে বলেছিলেন, জীবন থেকে আবেগটাকে ব্লটিং পেপারের মতো যদি শুষে নিয়ে যদি চলতে পারো তা হলে তোমার মিশন কখনও ব্যর্থ হবে না।
পত্রিকা: বেস্টের সঙ্গে আপনার আলাপ ছিল নাকি?
মর্গ্যান: ছিল মানে! ক্লাব পর্যায়ে দু’জনে একসঙ্গে খেলেওছি!
পত্রিকা: তাই?
মর্গ্যান: ওর সঙ্গে আলাপ আমার জীবনের প্রথম ক্লাব এএফসি বোর্নমাউথে। সেটা ১৯৮৩ সাল। গাওস্করদের ওয়ার্ল্ড কাপ জেতার বছর। বেস্ট তখন ফুটবল জীবন শেষের দিকে। যদিও খেলা দেখে সেটা মনে হত না। গোটা পাঁচেক ম্যাচে বেস্টের সঙ্গে স্ট্রাইকারে খেলেছি। খুব বেশি কথা বলত না। কিন্তু ভীষণ ডাউন টু আর্থ। মাঝে মাঝে মুড ভাল থাকলে আড্ডা জমিয়ে দিত। মজার ব্যাপার এটাই, সেই আড্ডায় বেস্ট এমন সব কথা বলত যেগুলোর ধার দিয়েও ও যেত না।
পত্রিকা: যেমন?
মর্গ্যান: যেমন, আমাদের বেশি মদ খেতে মানা করেই বারে গিয়ে নিজে একের পর এক পেগ উড়িয়ে দিত। ডিসিপ্লিন, একাগ্রতা নিয়ে এমন সব বক্তব্য রাখত শুনেই গায়ের রক্ত ফুটতে শুরু করবে। অথচ বেস্ট আর ডিসিপ্লিন দু’টোই দুই মেরু। সেটাই অবাক লাগত। অনেক পরে গিয়ে ধরতে পেরেছিলাম লোকটা ভীষণ একা। ওই আমার জীবনের দ্বিতীয় মানুষ যে বোঝাতে পেরেছিল, আবেগ থাকা ভাল। কিন্তু অতিরিক্ত আবেগ ক্ষতিকর।
পত্রিকা: প্রথম মানুষটি কে?
মর্গ্যান: আমার মা। জয়েস মর্গ্যান। ১৯৫৬ সালে আমি যখন জন্মাই তখন সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইংল্যান্ড। দেশের আর্থিক অবস্থা শোচনীয়। বাবা সেনাবাহিনীতে ছিলেন। সংসারে বেশি সময় দিতে পারতেন না। মাকে পার্টটাইম কাজ করতে হত সংসারে সচ্ছলতা আনতে।
পত্রিকা: আপনার ভাইবোন?
মর্গ্যান: আমার দু’বছরের বড় দিদি জয়। ওর সঙ্গে খুব খুনসুটি করতাম। |
|
পত্রিকা: পড়াশুনো?
মর্গ্যান: পড়তাম সাউথ ইস্টহ্যাম সেকেন্ডারি স্কুলে। কিন্তু লেখাপড়া সে ভাবে করা হয়ে উঠল না। পনেরো বছরের পর সব কিছু দিলাম ছেড়ে। আর তার পরেই জীবনযুদ্ধে নেমে পড়তে হল। ইনস্যুরেন্স এজেন্ট থেকে রেস্তোরাঁর ওয়েটার, অনেক কাজই করতে হয়েছে সংসার চালাতে। ওই সময় মা জীবনটাকে চিনতে শিখিয়েছিলেন।
পত্রিকা: একটা ব্যাপার বুঝলাম না, পনেরো বছর বয়সে পড়াশোনা হল না বলে কাজে লেগে পড়লেন। ফুটবল খেলতেন না?
মর্গ্যান: (অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন) ওই স্কুলে, পাড়ায় একটু আধটু। ফুটবলার হওয়ার পরিকল্পনা তখন ছিল না। তত দিনে জ্যাকির (জ্যাকলিন) সঙ্গে বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ভাবুন এক বার, চালচুলো নেই একটা লোকের। সে সংসারী হয়ে গিয়েছে। এর পরেও আমার আবেগ আছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন করবেন? জ্যাকি একটা বুটিকে কাজ করত। কোনও রকমে চলে যেত।
পত্রিকা: জ্যাকির সঙ্গে প্রথম দেখা কোথায়?
মর্গ্যান: নাইট ক্লাবে নাচতে গিয়ে। প্রথম দেখাতেই ওর দিঘল চোখ এবং ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম।
পত্রিকা: প্রথম প্রস্তাবটা কার কাছ থেকে এল?
মর্গ্যান: (মুখে লাজুক হাসি) মাস দু’য়েক জ্যাকির পিছনে দৌড়ে আমিই প্রস্তাবটা প্রথম দিয়েছিলাম। ও রাজি হয়ে যায়। বছর দেড়েক ঘোরাফেরার পর ১৯৭৯ সালে বিয়ে করে ফেলি।
পত্রিকা: তেমন কোনও রোজগার নেই। এ দিকে বিয়ে করছেন। বাড়িতে আপত্তি করেনি?
মর্গ্যান: না। মা কেবল বলেছিলেন, তোমার জীবন তুমিই ঠিক করবে।
পত্রিকা: ট্রেভর জেমস মর্গ্যান তা হলে ফুটবলটা খেলা শুরু করলেন কবে?
মর্গ্যান: তেইশ বছর বয়সে। কোনও কিছুই হচ্ছিল না। মা বললেন, ফুটবলটা তো পাড়ায় ভালই খেলো। পেশাদার ফুটবলটা একবার ট্রাই করে দেখতে ক্ষতি কি? ট্রায়াল দিলাম বোর্নমাউথে। ওঁরা শেষমেশ ডেকে নিলেন আমাকে।
পত্রিকা: স্ত্রী জ্যাকি ছাড়া আপনার পরিবারে আর কে কে আছেন?
মর্গ্যান: আমার দুই ছেলে জেমস আর অ্যালেক্স। কেউই ফুটবলার নয়। ছোটখাটো চাকরি করে। আমার মেয়ে লরেন। জামাই শন। ওদের দুই ছেলেমেয়ে। ফাইফ (নাতি) এবং এমরিস (নাতনি)। মেয়ে-জামাইয়ের ঘরে আরও একজন নতুন সদস্য আসছে সামনের সেপ্টেম্বরে।
পত্রিকা: জ্যাকি এক বার এই শহরে এসেছিলেন। তার পর চলেও গেলেন। আর এলেন না। ‘সিটি অফ জয়’ কি তা হলে জ্যাকির মন জয় করতে ব্যর্থ?
মর্গ্যান: না ঠিক তা নয়। আসলে ও একদম ঘরকুনো। তা ছাড়া কলকাতার গরমটা ওর সহ্য হল না। তাছাড়া পারথে আমাদের বাড়িটা সমুদ্রের একদম ধারে। জ্যাকি ওই পরিবেশ ছেড়ে কোথাও যেতে চায় না। তাই আমরা মাঝে মাঝে সিঙ্গাপুরে দেখা করে নিতাম।
পত্রিকা: এ ছাড়া কলকাতা থেকে বাইরে বেড়াতে যাননি কোথাও!
মর্গ্যান: না, সেভাবে আলাদা করে হয়ে ওঠেনি। ওই টিম নিয়ে যেটুকু যা ঘোরা হয়েছে। এমনিতে সমুদ্র আমার খুব ভাল লাগে। গোয়াটা দুর্দান্ত লেগেছে। গেলেই মনে হত, যেন ইংল্যান্ডের কোনও কোস্টাল সাইডে পৌঁছে গিয়েছি।
পত্রিকা: কলকাতাতেও এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াননি?
মর্গ্যান: সেকেন্ড হুগলি ব্রিজটা থেকে কলকাতাটা দেখতে বেশ কয়েক বার ওদিকে গিয়েছি।
পত্রিকা: জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি?
মর্গ্যান: না। দক্ষিণেশ্বর গিয়েছি। ওখানকার গঙ্গার ধারে গিয়ে মাঝে মাঝে বসেও থেকেছি। সিনিক বিউটিটা খুব এনজয় করেছি। এ ছাড়া কলকাতার সবচেয়ে যেটা ভাল, সেটা হল ময়দান। ভীষণ ফ্রেশ। আর কয়েকটা রাস্তা ... পার্ক স্ট্রিট, সেক্সপিয়র সরণি ...। আর হ্যাঁ, মনুমেন্টটা খুব ইন্টারেস্টিং লাগত। খুব ইচ্ছে ছিল, যদি ওটার ওপরে উঠতে পারতাম। চেষ্টা করে দেখেওছি। কিন্তু শুনলাম, নিয়ম নেই।
পত্রিকা: বিদেশিদের কাছে কলকাতা মানেই তো টেরিজা, টেগোর, সত্যজিত্ রায়। কলকাতায় পা দেওয়ার আগে এঁদের কথা জানতেন?
মর্গ্যান: দেখুন ১৫ বছরের পর সে ভাবে পড়াশোনা করিনি। কাজেই এই সব বড় মাপের ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে একটা কথা বলতেও আমার নিজের লজ্জা করে। তবে স্কুলে টেগোরের কবিতা পড়েছি। মাদার টেরিজার কথা জেনেছি অনেক বড় হয়ে। আর রে-র ছবি সে ভাবে দেখা হয়নি। তবে এটা জানি উনি অস্কার পেয়েছেন। কলকাতায় পা দেওয়ার আগে এই শহরের কোনও বিষয় নিয়ে যদি কিছু জেনে থাকি সেটা ইডেন গার্ডেন। টিভিতে ইডেনের বহু ক্রিকেট ম্যাচ ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ায় থাকতে দেখেছি।
পত্রিকা: গাওস্করের কথা বলছিলেন। আর কোন ভারতীয় ক্রিকেটারকে চেনেন?
মর্গ্যান: ফারুখ ইঞ্জিনিয়ার, পটৌদি, কপিল দেব। ১৯৭১-৭৪, এই সময়টা ভারতের ক্রিকেটটা খেয়াল করতাম। তখন এই নামগুলো পেতাম। ইদানীং খুব একটা খবর রাখি না। শুধু তেন্ডুলকরের নামটা জানি। ফেভারিট ক্রিকেটার অবশ্যই ইয়ান বোথাম। মানুষ হিসাবে ও অনেক বড় মাপের।
পত্রিকা: ভারতে এসে বেশির ভাগ বিদেশি বলিউডের প্রেমে পড়েন। আপনি হিন্দি সিনেমার কতটা ভক্ত হয়ে পড়লেন?
মর্গ্যান: খুব বেশি নয়। তবে অমিতাভ বচ্চন এবং সলমন খানের কিছুটা হলেও ভক্ত হয়ে পড়েছি। সলমনের চেহারাটা এক কথায় ফাটাফাটি। মাঝেমাঝেই শার্ট খুলে ফেলে (মুখে সেই দুষ্টু হাসি)। ওর মতো একটা চেহারা পেলে... ‘দাবাং’ ছবিটা মেহতাবের পাল্লায় পড়ে আমি সাত বার দেখেছি।
পত্রিকা: আর বাংলা ফিল্ম?
মর্গ্যান: না, একেবারেই না। তবে একটা গান শুনেছি... পাগলু, পাগলু... (সুর করে গেয়ে উঠলেন)।
পত্রিকা: একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন...
মর্গ্যান: বলুন।
পত্রিকা: বাঙালি মহিলাদের কেমন লাগল?
মর্গ্যান: সুন্দর। দে আর বিউটিফুল।
পত্রিকা: ব্যস্, এইটুকু...? কাউকে কখনও ভাল লাগেনি?
মর্গ্যান: (ফের হাসি) আপনি তো জ্যাকির সঙ্গে ডিভোর্স বাধিয়ে ছাড়বেন। এটা বলতে পারি, বাঙালি মহিলাদের চোখ এবং হাসিতে বেশ অ্যাপিল রয়েছে।
পত্রিকা: বান্ধবী নেই। ঘোরাঘুরিও বিশেষ করতেন না। মাঠের বাইরে সময়টা কাটাতেন কী ভাবে?
মর্গ্যান: কেন? আমার পরিবারের লোকজনদের সঙ্গে ফোনে আড্ডা দিয়ে। গান শুনে।
পত্রিকা: কী গান?
মর্গ্যান: ইংলিশ ক্লাসিকাল। বাখ, বিঠোফেন আমার অসম্ভব প্রিয়।
পত্রিকা: ইদানীং কলকাতার রাস্তার রেলিং, ব্রিজ সর্বত্র নীল-সাদা স্ট্রাইপ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। খেয়াল করেছেন?
মর্গ্যান: ভালই তো। আপনারা ফুটবল ভালবাসেন। মারাদোনা, মেসি এই শহরে পা রেখেছেন। কলকাতায় আর্জেন্তিনার প্রচুর সমর্থক। নীল-সাদা রং নিয়ে আপনাদের তো আপত্তি করা উচিত নয় (বলেই অট্টহাসি)।
পত্রিকা: জানেন এগুলো বাংলার রাজনীতিতে পরিবর্তনের ফল?
মর্গ্যান: জানি না। রাজনীতি থেকে আমি এক আলোকবর্ষ দূরে থাকি।
পত্রিকা: তাই? মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়...
মর্গ্যান: ইয়া। সি ইজ ভেরি এনার্জেটিক।
|
ছবি: কৌশিক সরকার |
|
|
|
|
|