ব্যাগ গুছিয়ে... বরফবৃষ্টির গাঁও
প্রিলের মাঝামাঝি, সকাল থেকে তুমুল বরফবৃষ্টি! কলকাতায় বসে স্বপ্নেও ভেবেছি কখনও?
ভাবার কথাও নয়। কিন্তু কলকাতায় না হোক, স্বপ্নের দেশে এ রকম অনেক কিছুই ঘটে। সেখানে এপ্রিল মাসেও ঝমঝম বৃষ্টির সঙ্গে হঠাৎ মুষলধারে পড়তে থাকে বরফের কুচি। কটেজের জানলার বাইরে জমতে থাকে সাদা পরত। গাড়ির কাচে, ওয়াইপারেও সাদা আস্তরণ। চার পাশে ঘিরে থাকা পাহাড়েরা মুখ লুকোয় মেঘের চাদরে।
আগের দিনটা কিন্তু দিব্যি ঝকঝকে ছিল। শ্রীনগর থেকে রওনা দিয়েছিলাম বেশ সকাল সকাল। ঘণ্টা তিনেকের পথ। গন্তব্য পহেলগাঁও। সঙ্গী কাশ্মীরি বন্ধু আলতাফ কথায় কথায় জানিয়েছিল, পহেল শব্দের অর্থ মেষপালক। পহেলগাঁও মানে মেষপালকদের গ্রাম। চার দিকে আকাশছোঁয়া পাহাড়ের পাহারার মাঝে একচিলতে জনপদ। কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলায়।
শ্রীনগর শহরের গণ্ডি পেরিয়ে উইলো গাছের সারিদের দু’পাশে রেখে সাঁ-সাঁ ছুটছিল গাড়িটা। কোথাও কোথাও দেখা মিলে যাচ্ছিল চিনার গাছের। পাহাড়ের কোলে সমতলে সর্ষে আর জাফরান খেত। কোথাও আবার মালবেরির চাষ হচ্ছে। দূরে পাহাড়ের ধাপে ধাপে মাথা তুলেছে পাইনেরা। পাইনের ঘন সবুজ আর তার নীচে সষের্খেতের হলুদ চাদর ঠিক যেন প্যাস্টেলে আঁকা ছবি। সোজাসুজি তাকালে চোখ ধাক্কা খাচ্ছে পাহাড়ের গায়ে। আর ধু ধু হাইওয়েটা এঁকেবেঁকে হারিয়ে গিয়েছে সামনে। মাঝে মাঝে হুড়মুড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে দু’একটা ট্যুরিস্ট গাড়ি। কখনও বা দেখা মিলে যাচ্ছে কাঠবোঝাই ঝুড়ি মাথায় টুকটুকে কাশ্মীরি মেয়েদের। বরফের খোঁজ অবশ্য তখনও মেলেনি। তবে খোঁজ মিলল আপেলবাগানের। এপ্রিল মাসে আপেলের দেখা নেই যদিও। গাছের ডালভর্তি শুধু সাদা-সাদা ফুল।
আগেই বললাম ঘণ্টা তিনেকের সফর। যতই এগোচ্ছি, টের পাচ্ছিলাম ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা আমেজটা ক্রমশ বাড়ছে। পথ ফুরোলো নন্দুর ধাবায় এসে। সেই জায়গাটা বেশ জমজমাট। বুঝলাম, এসে পড়েছি মেষপালকদের গ্রামে অর্থাৎ কিনা পহেলগাঁও-এ। কাশ্মীরি পোলাও, গুস্তাভা, মাটন রোগ্যানজোশ সহযোগে মধ্যাহ্নভোজটা নেহাৎ মন্দ হল না। গুস্তাভা এক রকমের মাংসের কোপ্তা। দই দিয়ে রান্না হয়। কাশ্মীরে এটা ছাড়া নাকি কোনও রকমের দাওয়াত হয় না, জানতে পারলাম আলতাফের কাছেই। এখানে আবার মিনি সুইজারল্যান্ড বলে একটা জায়গাও রয়েছে। ঘোড়ায় সওয়ার হয়েই যেতে হয় সেখানে। তবে পথটা খুব একটা সুবিধের নয়। বেশ চড়াই।
কাশ্মীর ভ্রমণের দ্বিতীয় দিন। তখনও পর্যন্ত বেশ রোদ ঝলমল করছে। রয়েছে হাল্কা ঠাণ্ডা। দূরে পাহাড়ের গা ছুঁয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে ধূসর মেঘেরা। দুর্যোগের কোনও আভাস নেই। উইলো গাছে ঘেরা কটেজে দুপুরের কিছুটা সময় কাটিয়ে রওনা দিলাম চন্দনওয়াড়ির উদ্দেশে।
এ বার বেশ চড়াই। পাহাড়ের বুক চিরে সোজা উপরে উঠে যাওয়া, পাশে লিডার নদীকে সঙ্গী করে। যাঁরা ট্রেক করে অমরনাথ যান, তাঁদের যাত্রা শুরু হয় চন্দনওয়াড়ি থেকেই। উঠতে উঠতেই চোখে পড়ছিল, পাথুরে রাস্তার ধারে ধারে জমে রয়েছে বরফের আস্তরণ। তবে গাড়ির ধুলো ধোঁয়ায় তার শুভ্রতা বিশেষ নেই। গন্তব্যে পৌঁছে গাড়ি থেকে নামতেই ছেঁকে ধরলেন উলের কোট আর গামবুট ভাড়া দেওয়ার লোকজন। সামনে তো শুধুই বরফ আর বরফ। গামবুট পরে না নিলে জুতো ভিজে একসা হবে!
দরাদরি করে জুতো ভাড়া নিয়ে পৌঁছনো গেল সেই বরফের রাজ্যে। তার পরে শুধুই বরফ লোফালুফি, নরম ঝুরঝুরে বরফে জুতো গেঁথে গেঁথে আরও খানিকটা উপরে ওঠার চেষ্টা। আর শেষে স্লেজে চড়ে গড়গড়িয়ে নেমে আসা। কুকুরে টানা স্লেজ যদিও নয়। তবু নিজেকে কেমন যেন সেই রুশ গল্পে পড়া ‘চুক আর গেক’-এর মতোই মনে হয়। আমার মাথায়ও তো তখন ওদের দেশের মতোই গুঁড়ো গুঁড়ো বরফ লেগে রয়েছে।
সূর্য তখনও মধ্যগগনে জ্বলজ্বল করছে। দুধ-সাদা বরফের স্তূপে রোদ ঠিকরে পড়ছে। আরও উপরে কালচে সবুজ পাইনের সারি। সেই দিগন্তবিস্তৃত ধু ধু সাদা প্রান্তরের দিকে বেশি ক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলে কেমন যেন চোখ ধাঁধিয়ে যায়। নাকে-মুখে ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা বেশ ভালই মালুম পড়ে। বরফ ছুঁয়ে আসা হাওয়ার ধাক্কায় চোখমুখের চেহারাই পাল্টে যায়।
চন্দনওয়াড়ির বরফ-বিলাস সেরে এ বার নেমে আসা বেতাব ভ্যালিতে। এখানে আর বরফের বাড়াবাড়ি নেই। এর আগে এই জায়গাটার নাম অন্য কিছু ছিল। ‘বেতাব’ সিনেমার বেশির ভাগটার শু্যটিং এখানে হওয়ায় নামটা বদলে গিয়েছে। সেই জায়গাটারও চার দিকে পাহাড়শ্রেণির প্রহরা। আর সবুজের সমারোহ। এ দিক-সে দিক দু’চারটে ঘোড়া চরে বেড়াচ্ছে। বিকেল বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ট্যুরিস্টদের ভিড়ও বাড়ছে। আর অবধারিত ভাবে কানে চলে আসছে বঙ্গসন্তানদের টুকরো টুকরো কথা চালাচালি। জানলাম, বহু জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমারই শু্যটিং হয়েছে এখানে।
তার পরে আবার উতরাই বেয়ে নেমে আসা পহেলগাঁওয়ে। বিকেলবেলাটা একটু ঘোরাঘুরি এলাকারই আশপাশে। পাহাড় আর নদীকে পাশে রেখে খুঁজে নেওয়া কাশ্মীরি শাল অথবা হাতের কাজের খুঁটিনাটির দোকান। কখনও বা ঢুঁ মারা আখরোটের দোকানে। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। কাজেই পত্রপাঠ নিজেকে ঘরবন্দি করা উইলোর জঙ্গলে ঘেরা কটেজে।
রাত বাড়তেই মালুম পড়ছিল ঠাণ্ডাটা জব্বর পড়েছে। মাঝরাত থেকে শুরু হল ঝুপঝুপ বৃষ্টি। মেঘের মনখারাপ মেখে উঁকি মারল ধূসর সকাল। কিন্তু বৃষ্টির বিরাম নেই। কটেজের বারান্দায় গিয়ে শীতের কামড়টাকে উপভোগ করছিলাম। তখনই এপ্রিলের প্যাচপেচে গরমে অভ্যস্ত বঙ্গসন্তানের চোখকে বিস্ময়ে গোলগোল করে দিয়ে হঠাৎ শুরু তুষারপাত। বৃষ্টির ফোঁটার সঙ্গেই পড়ে চলেছে গুঁড়ো গুঁড়ো বরফ। আর সঙ্গে কী ঠাণ্ডা, বাপরে! হাড়ের মধ্যে কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে একেবারে। তবু বারান্দা থেকে ভেতরে যেতে ইচ্ছে করছে না। কটেজের মধ্যে তখন গরম কফির পেয়ালায় ধোঁয়া উঠছে। আর বাইরে সাদা প্রলেপ জমছে উইলোর ডালে, বিদ্যুতের তারগুলোয়। ধন্য পহেলগাঁও।


কী ভাবে যাবেন
ট্রেনে জম্মু হয়ে শ্রীনগর। সরাসরি বিমানেও যাওয়া যায়। শ্রীনগর
থেকে ভাড়ার গাড়ি। সঙ্গে ঘুরে নিন গুলমার্গ, সোনমার্গ।
কখন যাবেন
ঘোর বর্ষা ছাড়া সব সময়। তবে শীতকালে খুবই ঠাণ্ডা পড়ে।
কোথায় থাকবেন
পহেলগাঁওয়ে জম্মু-কাশ্মীর ট্যুরিজমের কটেজ রয়েছে। রয়েছে অন্যান্য জায়গাও।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.