|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
বাংলার প্রবহমান পরম্পরা থেকেই লৌকিকের প্রেরণা |
গগনেন্দ্র প্রদর্শশালায় অনুষ্ঠিত হল যামিনী রায়ের ছবির প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ |
যামিনী রায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৮৭-র ১০ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বেলিয়াতোড় গ্রামে। ২০১২তে তাঁর জন্মের ১২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। সে উপলক্ষে এই বাংলায় বিশেষ কোনও উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা যায়নি। কেবল একটি দু’টি পত্রিকায় কিছু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। জন্মশতবর্ষে কলকাতায় তাঁর ছবি নিয়ে একটি প্রদর্শনীর কথা স্মরণে আছে। ২৫ বছর পরে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা কি আমরা বিস্মৃত হলাম?
এই অভাব খানিকটা প্রশমিত হল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চারুকলা পর্ষদ আয়োজিত যামিনী রায়ের ছবির একটি প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে। পর্ষদের নিজস্ব সংগ্রহের ৩৫টি ছবি নিয়ে সম্প্রতি গগনেন্দ্র প্রদর্শশালায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই প্রদর্শনীটি।
আমরা হয়তো আধুনিক চিত্রকলার ধারাবাহিকতায় যামিনী রায়ের তাৎপর্যকে তেমন করে মনে রাখিনি। সেই তাৎপর্য হয়তো এটাই যে বাংলা তথা ভারতের রূপগত স্বাতন্ত্র্যকে তিনি চিনিয়ে দিয়েছিলেন। ছবিতে এনেছিলেন ঔপনিবেশিকতার দাসত্ব-অতিক্রান্ত রূপের (ফর্ম) মুক্তি। বাংলার প্রবহমান লৌকিক পরম্পরা সঞ্জাত এক জাতিগত আত্মপরিচয় তুলে ধরেছিলেন।
আমরা যদি তাঁর সারা জীবনের কাজকে শ্রেণিবিভাজিত করতে চেষ্টা করি, তাহলে কয়েকটি পর্যায় লক্ষ করা যায়। প্রথম পর্যায় হচ্ছে স্বাভাবিকতার আঙ্গিকে আঁকা তাঁর ছবি ও প্রতিকৃতিচিত্র। ১৯০৬ থেকে ১৯১৪ পর্যন্ত কলকাতার আর্ট স্কুলে ছাত্রাবস্থায় তিনি স্বাভাবিকতার রীতিতে যে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন, লৌকিক পর্যায়েও সেই ভিত্তি তাঁর ছবিতে সারল্যের মধ্যেও দৃঢ়তা এনেছে। তার পরের পর্যায়ে তিনি স্বাভাবিকতাকে রূপান্তরিত করে ইম্প্রেশনিস্ট ও পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট আঙ্গিকে ছবি এঁকেছেন। তৃতীয় পর্যায়টি লৌকিক আঙ্গিকের। ১৯২০-র দশকের মাঝামাঝি থেকে শেষ জীবন পর্যন্ত ছিল এর বিস্তার। এর আগে অবশ্য অল্প সময়ের জন্য তিনি নব্য ভারতীয় ঘরানার আঙ্গিক নিয়েও চর্চা করেছেন। লৌকিক আঙ্গিকের প্রধান প্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন বাংলার প্রবহমান পরম্পরা থেকে যেমন, তেমনই শিশুর ছবির সারল্য থেকে। লৌকিক ভিত্তিক প্রবহমান কৌমচেতনাকেই তিনি আধুনিকতায় অভিষিক্ত করেছেন। বিংশ শতকের চিত্রকলায় এটাই যামিনী রায়ের প্রধান অবদান। |
|
শিল্পী: যামিনী রায় |
প্রদর্শনীতে বেশি ছিল পরিপূর্ণ লৌকিক আঙ্গিকের কাজ। এই আঙ্গিকের সূত্রেই যামিনী রায় আজ সারা বিশ্বে পরিচিত। প্রথম পর্বের অর্থাৎ স্বাভাবিকতার আঙ্গিকের কাজ এখানে প্রায় ছিল না বললেই চলে। তবে এখানে প্রদর্শিত একটি রচনা থেকে সেই রূপরীতির কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। শিরোনাম ‘গাঁধী ও রবীন্দ্রনাথ’। দুই মনীষীর মুখাবয়ব ও প্রতিকৃতির ভিতর স্বাভাবিকতার সুস্পষ্ট আদল রয়েছে। অথচ স্বাভাবিক ভাবেই তা নিশেঃষিত হয়নি। উদ্ভাসিত হয়েছে অন্য এক প্রজ্ঞা, যা অর্জন করেছিলেন লৌকিক অনুধ্যান দিয়ে।
দ্বিতীয় পর্যায় অর্থাৎ উত্তর-প্রতিচ্ছায়াবাদ আঙ্গিকের ছবির অন্তত দু’টি দৃষ্টান্ত এই প্রদর্শনীতে ছিল। শিরোনাম ‘গলি’। দ্বিতীয়টি ‘নিসর্গ’। দু’টি ছবিই অত্যন্ত সুপরিচিত। প্রথম ছবিটিতে সম্ভবত বাগবাজার অঞ্চলের একটি গলিপথের রূপারোপ। তাঁর কলকাতা বাসের প্রথম পর্যায় কেটেছিল বাগবাজারের আনন্দ চ্যাটার্জি লেনে। দু’পাশে বাড়ির দেওয়াল। মাঝখান দিয়ে সরু পথ চলে গেছে। সেই সময়ের উত্তর কলকাতার গলিপথের আদর্শায়িত রূপের স্মারক হয়ে আছে আজও এই ছবিটি। দ্বিতীয় ছবিটিতে যে নিসর্গ রূপায়িত, তা গড়ে উঠেছে বর্ণ প্রলেপের ছোট ছোট মোজাইকে। ভ্যান গঘ তাঁর অত্যন্ত প্রিয় শিল্পী ছিলেন। তাঁর অন্তর্দৃষ্টিকে আত্মস্থ করতে চেষ্টা করেছেন যামিনী রায়। এরই কিছু আভাস রয়েছে।
নব্য-ভারতীয় ঘরানার বৈশিষ্ট্যকেও যে এক সময় তিনি অনুধাবন করতে চেষ্টা করেছিলেন, তার পরিচয় রয়েছে এই প্রদর্শনীর ‘বুদ্ধ’ ছবিটিতে। এই ছবির আঙ্গিক পুরোপুরি লৌকিক নয়। আবার সম্পূর্ণ ধ্রুপদীও নয়। দুইয় সমন্বয়ে গড়া। প্রদর্শনীর বাকি প্রায় সব ছবিতেই দেখি তাঁর লৌকিক প্রজ্ঞা। তার পরিচয় রয়েছে শুধু রেখাতেই আঁকা ‘মা ও শিশু’ ছবিটিতে। পরিশীলিত লৌকিক অলঙ্করণ তাঁর আঙ্গিকের বৈশিষ্ট্য। গাছের উপর বসে বাঁশি বাজাচ্ছে কৃষ্ণ। বৃক্ষমূলে দাঁড়িয়ে চার গোপিনী। জলস্রোতে ভেসে যাচ্ছে মাছেরা। পুরাণকল্পের এই রূপায়ণের মধ্য দিয়ে বাংলার চিরন্তন প্রজ্ঞাকে রূপবদ্ধ করেছিলেন যামিনী রায়। |
|
|
|
|
|