যে দেশটি ঐতিহাসিক ভাবে এশীয় মহাশক্তির খেতাবের প্রথম দাবিদার, তাহার নাম জাপান। বিগত এক দশক জাপানের ভাল যায় নাই। অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যভঙ্গ ঘটিয়াছে, সেই ধাক্কায় রাজনীতি টালমাটাল হইয়াছে। ২০০৭ হইতে ২০১২ পর্যন্ত সাত বার দেশের প্রধানমন্ত্রী বদলাইয়াছে। স্বভাবতই দেশটির কূটনৈতিক তৎপরতাও কমিয়া আসিয়াছিল। গত ডিসেম্বরে শিনজো আবে ফের প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হইয়া অর্থনৈতিক সংস্কারের সিদ্ধান্ত করিয়াছেন। কূটনৈতিক ভাবেও সক্রিয় হইয়াছে জাপান। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের জাপান সফর, শুধুমাত্র এই সময়টির জন্যই, বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হইয়া উঠিতে পারে। প্রধানমন্ত্রী জাপানকে ভারতের ‘স্বাভাবিক এবং অপরিহার্য দোসর’ হিসাবে বর্ণনা করিয়াছেন। কথাটির সত্যতা প্রশ্নাতীত। প্রশ্ন হইল, কথাটি কাজে পরিণত হইবে কি না। ২০০৬ সালে যখন আবে-ই জাপানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখনও তিনি ভারতের সহিত সম্পর্ক মজবুত করিবার কথা বলিয়াছিলেন। তাহার পর সেই কথা হারাইয়া গিয়াছে।
জাপানের সহিত সম্পর্কটি দৃঢ়তর করিতে ভারতকে উদ্যোগী হইতে হইবে। সম্প্রতি ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে সংশোধিত বিনিময় হারের মাপকাঠিতে) জাপানকে ছাপাইয়া গিয়াছে। কিন্তু ইহাতে ‘সে কী মা হর্ষ’ গাহিবার কোনও কারণ নাই। ১৩ কোটি মানুষের মোট আয়ের সহিত ১২০ কোটির মোট আয়ের তুলনা অর্থহীন। আর্থিক শক্তির যে কোনও সঙ্গত মাপকাঠিতেই জাপান বিস্তর অগ্রবর্তী। তাহার শরিক হইলে ভারতের মঙ্গল। এশিয়ায় ভারত বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যাহাতে সম্পূর্ণ চিন-নির্ভর না হইয়া পড়ে, তাহার জন্যও জাপানের সহিত ঘনিষ্ঠতা প্রয়োজন। কিন্তু শুধু অর্থনীতি নহে, সামগ্রিক কূটনীতির স্বার্থেই এই দুইটি দেশকে কাছাকাছি আসিতে হইবে। ভারত ও জাপানের এই সাম্প্রতিক ঘনিষ্ঠতাকে বেজিং সুনজরে দেখে নাই। চিনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম লিখিয়াছে, কোনও অভ্যন্তরীণ বা আন্তর্জাতিক উসকানিতে যাহাতে ভারত ও চিনের সম্পর্কে আঁচড় না লাগে, সেই দিকে নজর রাখিতে হইবে। এই প্রচ্ছন্ন হুমকিকে ভারত কতখানি গুরুত্ব দিবে, তাহা ভারতকেই স্থির করিতে হইবে।
সত্য, চিন যদি ভারতের উপর ভূ-রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করিতে চাহে, জাপানের সহিত ঘনিষ্ঠতায় তাহাকে রোধ করা যাইবে না। সে জন্য সর্বাপেক্ষা সহায়ক হইতে পারে ওয়াশিংটন ডি সি। কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নিজের প্রভাব বিস্তার করার কাজে বিন্দুমাত্র শৈথিল্যও ভারতের পক্ষে ক্ষতিকর হইতে পারে। চিন কার্যত ভারতকে ঘিরিয়া রাখিয়াছে। ভারতের প্রতিবেশী সব দেশের বন্দর ব্যবহারের অধিকার চিনের আছে। ভারতকে এর পাল্টা কূটনৈতিক দৌত্য চালাইতেই হইবে। জাপান তো বটেই, ভিয়েতনামের ন্যায় দেশের সহিতও মসৃণ সামরিক সম্পর্ক রাখা প্রয়োজন। এই একবিংশ শতাব্দীতে কূটনীতি অর্থনীতির হাত ধরিয়া চলে। অতএব, ভারত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আর্থিক ভাবে যত বেশি তৎপর হইবে, তত ভাল। |