সম্পাদকীয় ১...
যে যেখানে
মাধ্যমিক পরীক্ষায় জেলা জয়ী, কলিকাতা পরাজিত। অন্যান্য বৎসর কলিকাতার পরীক্ষার্থীরা তবু প্রথম দশটির মধ্যে দুই-একটি জায়গা করিয়া লইতে পারেন, এ বার শূন্য। মনে হইতে পারে, ইহা কলিকাতা-কেন্দ্রিকতার অবসানের সূচক শিক্ষার সম্প্রসারণ ঘটিয়াছে, পঠনপাঠনে জেলা অগ্রসর হইয়াছে। পরিসংখ্যানের এরূপ ব্যাখ্যা অতীতেও শোনা গিয়াছে। বাম আমলেই মাধ্যমিকে জেলার জয়ের সূচনা হইয়াছিল, এই বিষয়েও পরিবর্তনের সরকার তাহার পূর্বসূরির অনুবর্তী। সুতরাং শাসকদলের ভাগিনা তস্য ভাগিনা বলিতেই পারেন: শিক্ষার বিস্তার সম্পূর্ণ, কলিকাতার পড়ুয়ারা মাধ্যমিকের মেধা তালিকায় আর হুঁ করে না, হাঁ করে না, জেলায় জেলায় শিক্ষার পত্রপুষ্প খসখস গজগজ করিতেছে। ইহা শুনিয়া শাসক দলের মন্ত্রীরা হয়তো খুশি হইবেন, ভাগিনাদের শিরোপা দিবেন। কিন্তু যাঁহাদের দৃষ্টি ও যুক্তিবুদ্ধি খোলা, তাঁহারা বলিবেন, নব্য তোতাকাহিনিটি অন্যপ্রকার। অতি বিচিত্রও।
কাহিনির বীজ বাম আমলেই উপ্ত হইয়াছিল। মাধ্যমিক নামক রাজ্যের বিদ্যালয় শিক্ষাস্তরে যথার্থ সাম্যের জয়ধ্বজা উড়াইবার কঠিনকে সহজ করা হইয়াছিল: যে উচ্চে ছিল তাহাকে টানিয়া সমতলে ফেলা হইল। প্রাথমিকে ইংরাজি শিক্ষার অপসারণ করা হইল, সাহিত্যগুণশূন্য প্রায়োগিক ইংরাজি কোনও ক্রমে শেখানো হইল, ছাত্র ‘দ্য ডগ ইজ ঘেউঘেউয়িং’ লিখিলেও পরীক্ষকদের শূন্য দিতে নিষেধ করা হইল, গণিত ‘সহজতর’ হইল, ক্রমে পাশ-ফেল প্রথা উঠিল। সেই ইংরেজিবিহীন, পাশফেলের বাধাশূন্য সহজিয়া শিক্ষাব্যবস্থা প্রথম প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের কতটা পড়াশোনা শিখাইতে পারিল, বলা মুশকিল, তবে সচেতন শিক্ষিত ভদ্রলোক পরিবারের অভিভাবকরা প্রমাদ গনিলেন। আশির দশকের প্রথম দিকেও বলা হইত, ‘দিল্লি বোর্ড’-এর ইংরাজি মাধ্যমের পড়ুয়াদের ন্যায় পশ্চিমবঙ্গের মাধ্যমিক বোর্ডের বাংলা মাধ্যমের ভাল ছাত্রছাত্রীরা চোখে-মুখে ইংরেজি বলিতে না পারিলেও এবং উপরচালাকি না শিখিলেও পড়াশোনা যথার্থই শেখে। কথাটি নিতান্ত অহেতুক ছিল না। সহজিয়া ব্যবস্থা লাগু করিয়া যখন সবাইকে টানিয়া নামাইবার সাম্যবাদী প্রয়াস করা হইল, তখন এই শেখা বিষয়টি উধাও হইল। ফলে সচেতন পিতামাতা মাধ্যমিক বোর্ডের পাঠ্যসূচির এই লঘুকরণ দেখিয়া পুত্রকন্যাদের দিল্লি বোর্ডে স্থানান্তরিত করিলেন। বিশেষ করিয়া কলিকাতা ও তাহার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সচেতন ভদ্রলোক গৃহস্থ ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের কথা ভাবিয়া মাধ্যমিক বোর্ড হইতে পলাইয়া বাঁচিলেন। কলিকাতার ঐতিহ্যশালী বিদ্যালয়েও অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের পড়ুয়ারা আসা বন্ধ করিলেন। এই সকল বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ও বর্তমান পড়ুয়াদের শ্রেণিগত পরিচয় বিচার করিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হইবে। এই পলায়নের সহিত জেলার পড়ুয়াদের মাধ্যমিকে ভাল ফলের অনিবার্য যোগ রহিয়াছে।
সত্য কথাটি ইহাই যে, ক্রমে মাধ্যমিক মুখ্যত জেলার পরীক্ষা হইয়া উঠিয়াছে। জেলায় জেলায় সর্বভারতীয় বোর্ডের উচ্চমানের বিদ্যালয়ের সংখ্যা তুলনায় নিতান্ত কম। ফলে কলিকাতায় ‘মেধাবী’রা ভিন্নবোর্ডে চলিয়া যাইলেও জেলায় সেই চলিয়া যাইবার কাণ্ডটি ঘটিতে পারিয়াছে অনেক কম। মেধাবী শব্দটি সম্বন্ধে সতর্ক হওয়াও ভাল। অনেক ক্ষেত্রেই অন্তর্নিহিত মেধা অপেক্ষা বাড়িতে ও স্কুলে পড়ার সুযোগ এবং পারিবারিক স্বাচ্ছন্দ্য ছাত্রছাত্রীর শিক্ষার পক্ষে অনেক বেশি মূল্যবান হইয়া ওঠে। যে সকল পরিবারে এই সব সুবিধা বেশি, কলিকাতায় তাঁহাদের নিকট সর্বভারতীয় বোর্ডের স্কুলে ছেলেমেয়েকে পাঠানোর সুযোগও অনেক বেশি, অন্যত্র তাঁহারা কিছুটা বাধ্য হইয়াই মাধ্যমিকে থাকেন। পরীক্ষার ফলে ইহার প্রভাব পড়িবেই। সুতরাং মাধ্যমিকে জেলার ভাল ফলকে জেলার জয় বলিয়া ঘোষণা করিবার কারণ নাই। জেলার পরীক্ষায় জেলা জিতিয়াছে, ইহাই সহজ সত্য। যাহারা ভাল ফল করিয়াছে, জেলায় হোক বা কলিকাতায়, তাহাদের কৃতিত্ব এবং সেই কৃতিত্বের পশ্চাদ্বর্তী নিষ্ঠা ও শ্রম অবশ্যই অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু জেলায় জেলায় পঠনপাঠনের উৎকর্ষ ও সুযোগ বাড়ানোই হওয়া উচিত প্রকৃত লক্ষ্য। কলিকাতাতেও। এখানে কোনও লড়াই নাই।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.