অঝোরে কাঁদছিলেন টালিগঞ্জের পোড়খাওয়া হেয়ারড্রেসার রিনা মণ্ডল। ‘‘ও এত সাজতে ভালবাসত! ওকে একটু চন্দন পরালে না?” তরুণ চলচ্চিত্রকার অদিতি রায় তাঁকে সান্ত্বনা দিলেন, “খুব সুন্দর দেখতে লাগছে ঋতুদাকে!”
কপালে চন্দন নেই। কিন্তু মেরুন রঙের ছাপা কাজ করা একটি স্কার্ফ চুড়ো করে পাগড়ির মতো ঋতুপর্ণ ঘোষের মাথায় বেঁধে দেওয়া হল। ঠিক যেমনটি ভালবাসতেন তিনি। বাড়ি থেকে বার করার আগে বন্ধুরা এক বার ভেবেছিলেন, মেক-আপ করে সাজিয়ে দেবেন। পরে তাঁরাই ঠিক করলেন, দরকার নেই! ঋতু ইদানীং সাজগোজ, গয়না-টয়না পরা অত পছন্দ করছিলেন না। কিন্তু প্রয়াত চলচ্চিত্রকারের মাথায় থাকল তাঁর প্রিয় পাগড়ি। আর গায়ে কালো জ্যাকেটের উপরে বিছিয়ে দেওয়া হল সাদা জমিতে কালো নকশার রেশমি কাঁথা। বন্ধুরা বললেন, ‘এ হল বাঙালির ঋতুপর্ণের গায়ে বাঙালিয়ানার স্মারক’। |
সাজগোজের তত্ত্বাবধানে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে ব্যস্ত থাকলেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। আর বাইরে ঋতুপর্ণের বাড়ি ‘তাসের ঘর’-এর উপরে জনবিস্ফোরণ ঠেকাতে মাইক হাতে হাল ধরলেন প্রসেনজিৎ। প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড লাগোয়া ইন্দ্রাণী পার্কে প্রয়াত চলচ্চিত্রকারের বাড়ি, নন্দন-চত্বর, টেকনিশিয়ান্স স্টুডিও থেকে সিরিটি শ্মশান সর্বত্র টালিগঞ্জের নবীন-প্রবীণ বাহিনী একজোট হয়ে স্বেচ্ছাসেবীর ভূমিকায়।
বাংলার প্রবীণতম চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন, গৌতম ঘোষ, রাজা সেন, হরনাথ চক্রবর্তী থেকে শুরু করে তরুণতরদের মধ্যে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, সুদেষ্ণা-অভিজিৎ, বিরসা দাশগুপ্ত, রাজ চক্রবর্তী, সৃজিত মুখোপাধ্যায়, মৈনাক ভৌমিক, পরমব্রত, পাওলি কে নেই সেই ভিড়ে। মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের সঙ্গে প্রযোজক মণি-শ্রীকান্তরাও রীতিমতো ব্যস্ত সব কিছু সামলাতে। ঋতুপর্ণের ব্যোমকেশ, মুম্বইয়ের ‘কহানি’-খ্যাত সুজয় ঘোষ ছিলেন টেকনিশিয়ান্স স্টুডিওর চার নম্বর ফ্লোরে। স্নেহভাজন যিশু সেনগুপ্ত বিদেশে। |
তাঁর স্ত্রী নীলাঞ্জনা তাই সকাল থেকেই ‘ঋতুদা’র বাড়িতে। চলচ্চিত্র-জগতের বাইরে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, জয় গোস্বামীরাও বাড়িতে এসেই ঋতুকে দেখে গেলেন। ঋতুপর্ণকে ঘিরে এই তারকা-সমাবেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই দুপুর থেকে নন্দন-চত্বরে শেষ দেখা দেখতে আসা জনতার লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। মরদেহ ইন্দ্রাণী পার্কের বাড়ি থেকে বার করার ঢের আগেই টিভি-তে খবর পেয়ে জমায়েত বেড়েছে নন্দনে।
“এই দেখতে আসা কোনও হঠাৎ হুজুগ নয়,” বলছিলেন তরুণ ব্যবসায়ী অমিত রায়। তাঁর কথায়, “আরে বাবা, বাঙালি তো বাংলা ছবি থেকে মুখ ফিরিয়েই নিয়েছিল। সেই দুঃসময়ে বাঙালিকে ফের সিনেমা-হলে বাংলা ছবি দেখতে টেনে আনার কাজটা তো এই লোকটাই শুরু করেছিল।” ঠাকুরপুকুরের প্রযুক্তি সরকারও এসেছেন এক বন্ধুর সঙ্গে। ওই বন্ধুর স্বামী পেশায় মুম্বইয়ে সিনেমার এডিটর। তাঁর মারফতই খবরটা আসে প্রযুক্তিদের কাছে। ওঁরা সটান নন্দনে এসে ধর্না দিয়েছেন তখন থেকেই। নন্দনে মরদেহ রাখার সময় পেরিয়ে যাওয়ার মুখেও ভিতরে ঢোকার কী আকুতি! এক মহিলার চিৎকার, ‘আমি ওঁর ছবিতে অভিনয় করেছি, আমায় ঢুকতে দেবেন না?’ ভিড়ের মধ্যেই কে প্রশ্ন করলেন, ‘কোন ছবি?’ জবাব: ‘আমি টালিগঞ্জের এক জন একস্ট্রা। কোন ছবিতে মুখ দেখিয়েছি, বলতে পারব না!’ |
সকালে ইন্দ্রাণী পার্কের বাড়িতে ভিড় বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে বাইরে ব্যারিকেড গড়ার দায়িত্ব নেন টলি-ব্রিগেডের তরুণরাই। তখনও আবদার, ‘প্লিজ আমায় যেতে দিন, আমি ছোটবেলার বন্ধু!’ কিংবা ‘আমি সাউথ পয়েন্টে ওঁর সঙ্গে পড়েছি, এক বার দেখতে দিন না!’ ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে বাড়ির দরজায় এই আকুতি দেখতে দেখতে ভিড় থেকে সরে এলেন অভিনেতা বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী। ‘তাসের ঘর’ লাগোয়া গলিতে দাঁড়িয়ে অস্ফুটে তাঁর মন্তব্য, ‘‘খুব রাগ হচ্ছে, জানেন! খুব রাগ! যে লোকটার কত কিছু দেওয়ার ছিল, তাকে এই সময়ে এ ভাবে কেউ কেড়ে নেয়!’’
শ্রদ্ধার, ভালবাসার কত রংই যে মিশেছে আবেগ-ভরা জমায়েতে। রাষ্ট্রীয় অভিবাদনের তোপধ্বনি যেমন ছিল, তেমনই প্রান্তিক যৌনতার প্রতিনিধিদের তরফে লাল গোলাপও অঞ্জলি হয়ে ঝরে পড়ল। শোকের সাদা ফুলের পাশে ওই লাল রং তখন একটি সফল জীবনের উৎসব হয়ে উঠেছে। শ্রদ্ধা জানিয়ে রকমারি পোস্টারেরও মেলা! স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রদের শ্রদ্ধার্ঘ জমা হয়েছে প্রয়াত চলচ্চিত্রকারের বাড়িতে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনীর জন্য সেখান থেকে ফুল এল নন্দন-চত্বরে।
সিরিটি শ্মশানে শেষকৃত্যের প্রস্তুতি অনেক আগেই নেওয়া হয়েছিল। ব্লিচিং-গুঁড়ো ছড়িয়ে সব কিছু আগে থাকতেই তকতকে। টেকনিশিয়ান্স স্টুডিও থেকে পায়ে হেঁটে শোকযাত্রীরা সিরিটি পৌঁছলেন। পুরোভাগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রসেনজিৎ। পিছনে সাধারণ অনুরাগীরা।
সমাজের সব স্তরের মানুষকে মিলিয়ে দিয়ে গেল একটি মৃত্যু। |