একজন সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করতে চায়। আরেকজন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে নতুন দিশার সন্ধান পেতে চায়। প্রথমজনের ঠিকানা জগদ্দলের গোলঘরে ১নম্বর কেবিন রোড। টালির চাল, ৬বাই আট ফুটের দরমা আর ঝামা ইটের দেওয়ালের ঘর। দ্বিতীয়জনের বাড়ি জগদ্দল স্টেশনের কাছে রেল কলোনির বেড়ার ঝুপড়ি। দু’জনকেই সবাই চেনে ভাল ছাত্র বলে। এবারের মাধ্যমিকে স্থানীয় সুন্ধিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের এই দুই কৃতির নাম যথাক্রমে অরূপ বিশ্বাস ও রঞ্জন দাস।
অরূপদের এক কামরার ছোট্ট বাড়িতে তিনজনের সংসার। বাবা বৃন্দাবনবাবুই একমাত্র রোজগেরে। শ্যামবাজারের একটি প্যাথলজিক্যাল সেন্টারে মাসিক ৩৩০০ টাকা বেতনে নিরাপত্তা রক্ষীর কাজ করেন। কামাই করলে বেতন কাটা যায়। এই রোজগারে সংসার চলে না সেখানে গৃহশিক্ষক রাখাটা দুঃস্বপ্নের মতো। ‘‘তবু বাবা-মা কৃচ্ছসাধন করে তিনজন গৃহশিক্ষক রেখেছিলেন। তাঁরা অবশ্য আমাদের অবস্থা বিবেচনা করে বেশি টাকা নেননি।’’
—তক্তপোশে বসে একাদশ শ্রেণির বইতে চোখ রেখে বলে, অরূপ। তার মতে পড়ার কোনও বিকল্প নেই। বাড়িতে টিভি নেই। বিনোদন মানেও অরূপের কাছে গল্পের বই। তবে পড়ার সময় ঘড়িতে বাঁধা রাত ১২টা পর্যন্ত। বৃন্দবনবাবুকে ভোরে বেরোতে হয়। তাই ১২টায় ঘুমনোর সময়। এক কামরার ঘরে আলো জ্বেলে পড়া সম্ভব হয় না অরূপের। স্কুলে সব থেকে বেশি নম্বর পাওয়া ছাত্রটির মাধ্যমিকে প্রাপ্ত নম্বর ৬২৬। অপছন্দের বিষয় ইতিহাসেই পেয়েছে ৯৮। আর সবথেকে প্রিয় বিষয় অঙ্কে মিলেছে ৯১। |
উচ্চমাধ্যমিকে বাকী ৯ নম্বরের ঘাটতি মেটাতে স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেই আদা-জল খেয়ে লেগেও পড়েছে। স্কুলের শিক্ষক আর শুভানুধ্যায়ীরাই খাতা-বইয়ের জোগাড় করেছেন এতদিন। এখন অবশ্য অনিশ্চিত অবস্থা। ভর্তির ফর্ম যোগাড় করলেও কোথায় ভর্তি হবে এখনও ঠিক করতে পারেনি অরূপ। নিজেই বলে, ‘‘সব স্কুলে ভর্তির লম্বা লাইন। ভাল রেজাল্ট করতে গেলে ভাল স্কুলের প্রয়োজন। লেখাপড়ার পরিবেশ, আর ভাল শিক্ষক না হলে একা একা পড়ে কিছু করা অসম্ভব সেটা নিজেকে দিয়ে বুঝেছি।’’
বৃন্দাবনবাবু বা অরূপের মা শিখাদেবী ছেলের অধ্যাবসায়ে গর্বিত। তাঁদের কথায়, ‘‘ছেলেটা পড়তে ভালবাসে। আমাদের সাধ্য সীমিত। ওর ইচ্ছে পূরণ করতে না পারলে না খেয়ে থাকার থেকেও বেশি কষ্টে থাকতে হবে।’’
অরূপের বন্ধু রঞ্জনের স্বপ্ন ইঞ্জিনিয়ার হওয়া। রিসার্চ করা এমন বিষয়ে যা মানুষের কাজে লাগবে। নিজের দুরবস্থা থেকেও বেরোতে চায় সে। এই রেল কলোনি অনিশ্চয়তার ঠিকানা। কোনওদিন উঠে যেতে হবে কে জানে। বাবা রবীন্দ্রনাথবাবু গোলঘরের একটি লাইন হোটেলে রান্না করেন। মাসিক আয় মেরেকেটে হাজার পাঁচেক টাকা। বাবা-মা আর দুই ভাই। ছোট ভাই ক্লাস থ্রিতে পড়ে। রঞ্জনের গৃহশিক্ষক তার এক কাকা। স্কুলের টিফিনের সময় অন্যরা যখন হুল্লোড় করত রঞ্জন তখন মগ্ন হত কাকার দেওয়া হোমটাস্কে। এবারের মাধ্যমিকে ৫৪২ নম্বর পাওয়া রঞ্জনের অপছন্দের বিষয় ইতিহাস এবম তাতে প্রাপ্ত নম্বর ৯৩। কি করে ইতিহাসে এত নম্বর এল? সহাস্য জবাব, ‘‘সব সোজা প্রশ্ন ছিল। তাছাড়া পড়ার বইকে ভালবেসে পড়লে অপছন্দের বিষয় হলেও মনে থেকে যায়। জানেন, গল্পের বই পড়তে ভাল লাগে কিন্তু বাবারতো অত টাকা নেই। আমার পাঁচটা গল্পের বই আছে। মাঝে-মাঝে সেগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়ি।
স্কুল কেমন হওয়া উচিত? রঞ্জনের কথায়, ‘‘আমাদের স্কুলের মতো। মাস্টারমশাইরা যেখানে অভিভাবক। পড়া বুঝতে চাইলে যেখানে বারবার দেখিয়ে দেওয়া হয়। এমন স্কুলইতো খুঁজছি উচ্চমাধ্যমিকের জন্য। কিন্তু ভালো স্কুলগুলোতে টাকা নিয়ে ভর্তি করাচ্ছে। আমাদের অত টাকা কই?’’
সুন্ধিয়া স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক মুক্তকমল পাল বলেন, ‘‘আমাদের স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগ নেই বলে ওদের ধরে রাখা গেল না। কিন্তু ওদের অভিভাবকদের বলেছি, উচ্চ শিক্ষায় যে কোনও প্রতিকূলতায় আমাদের কাছে আসতে। সব বাধা আমরা সরাব। ওরা বড় মানুষ হোক।’’ |