অদূরে বাংলাদেশ সীমান্ত। লোক ও যন্ত্রচালিত যানের ঠেলাঠেলি বেড়ে গেছে পালে পালে গরুর চলাচলে, যে গরু সকলের জ্ঞাতসারে, কিন্তু বেআইনি ভাবে সীমান্ত পেরোবে। উত্তর ২৪ পরগনার স্বরূপনগর বললেই দেশ-কাল বিষয়ে ওয়াকিবহাল বঙ্গবাসী বলে উঠবেন, ‘স্বরূপনগর! উরিব্বাস, সে তো পাচারের জায়গা!’ এক বার একটা ছাপ লেগে গেলে অন্য সব বৈশিষ্ট্যের অবলুপ্তি। যেমন পশ্চিমবঙ্গ; এখানে দলবাজি ছাড়া কিছু হয় না, কেউ কিছু করে না, যেন ন’কোটি লোক দলোচ্ছ্বাসেই বেঁচে আছে।
কিন্তু ছাপ তো ছাপমাত্র, আর বস্তুজগৎ বিচিত্রগতি। সেই গতিময়তার এক খণ্ডচিত্র দেখার সুযোগ হল স্বরূপনগরে, একটা ‘বই পড়ার উৎসবে’। এগারোটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ষাট জন বালিকা ও বালক একটা গোটা দিন কাটাল ইচ্ছা মতো বেছে নেওয়া বই পড়ে, ছবি এঁকে, নাচগান করে। আয়োজন করেছেন প্রাথমিক শিক্ষকরাই।
‘বাচ্চারা পড়তে চায় না’ বহু শুনেছি। সত্যি? যাচাই করার জন্য প্রতীচী ট্রাস্ট ও ‘ক্রাই’ গত দেড় বছরে বীরভূম জেলায় পঁচিশটা ‘বই পড়ার উৎসব’ করে। পড়তে চায় না? বরং উল্টোটাই দেখা গিয়েছিল সেখানে। শুধু, বাধ্যতা নয়, বই পড়ায় আনন্দের ভাগ থাকা দরকার। (দ্রষ্টব্য: পড়ার আনন্দে, প্রতীচী ট্রাস্ট)
কিন্তু বীরভূমের আয়োজনগুলো তো ছিল একটা কর্মসূচির অঙ্গ, কর্মীরা স্কুলে স্কুলে গিয়ে প্রস্তুতি নিয়েছেন। স্বরূপনগরে তেমন কিছুই ছিল না। শিক্ষকরা লোকমুখে জেনে, নিজের খরচে বীরভূম গিয়ে সব দেখে এসে, নিজেদের মতো করে এ রকম নানান কাজে হাত দিয়েছেন, যেগুলোর একটাই দিশামুখ, ‘সব শিশুই শিখবে, সব শিশুকে আরও ভাল করে শেখাতে হবে।’ |
শুধু কথার কথা নয়। যে বালকটি লিখবার ভয়ে স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছিল, তারই একটা লেখা দেখলাম একটা স্কুলের স্থানীয় ভাবে কম খরচে ছাপানো একটা পত্রিকায়: ‘আমি ভাল ছেলে। আমি ফুচকা খেতে ভালবাসি।’ শুনলাম, ছেলেটার নামের সঙ্গে ‘খারাপ ছেলে’ ছাপ লেগে গিয়েছিল। লিখতে শিখেই সে বোধহয় প্রতিবাদ জানিয়ে উঠল ‘আমি ভাল ছেলে’। স্কুলগুলোতে চালু হওয়া দেওয়াল পত্রিকা ও ছাপানো পত্রিকায় শিশুরা নিজেদের ঘোষণা করছে। নানান সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে লেখাপড়ায় দুর্বলতম শিশুটিরও সরব উপস্থিতি। যে মা স্কুলের ধার মাড়াতেন না, এখন সেখানেই তাঁর নিত্য আনাগোনা। যে অনাথ শিশু কোথাও একফোঁটা স্নেহস্পর্শ পায়নি শিক্ষকের কোমল আশ্বাসে সে এঁকে ফেলছে আশ্চর্য রবীন্দ্রনাথ। স্কুল বন্ধ থাকলে তার মন খারাপ।
সহজ কাজ তো নয়। প্রত্যেক শিশুকে আলাদা আলাদা করে, সম্মান দিয়ে চেনা, তার পছন্দ-অপছন্দ, দক্ষতা-দুর্বলতাগুলো বুঝে সেই মতো আচরণ করা পরিশ্রমসাপেক্ষ; অনেক বেশি হৃদয়ের অনুশীলনসাপেক্ষ। এতে এমন এক মন লাগে, যা গড়ে ওঠে অনেকে মিলে, প্রকৃত অর্থে একসঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতায়। স্বরূপনগরের মতো একটা জায়গা, যেখানে এক-তৃতীয়াংশ বাড়ির জীবিকা হচ্ছে খেতমজুরি, দুই-তৃতীয়াংশ জনসমষ্টি সামাজিক পশ্চাৎপদ গোষ্ঠীর অংশ, যেখানে রাজনৈতিক অসদুদ্দেশ্যে সীমান্ত হয়ে ওঠে এক সামাজিক সমস্যা, সেখানে কী করে গড়ে উঠছে শিক্ষার এক অন্যতর পরিবেশ? আশ্চর্য উত্তর এক শিক্ষকের: ‘আমরা এখানে একটা পার্টি গড়ে তুলেছি! টিচার্স পার্টি!’ কৌতুকটা ধরতে পারলাম না দেখে বললেন, ‘টি এম সি’ আর ‘সি পি এম’। দুটোর ‘এস’ আর ‘সি’গুলো কাটাকুটি, হাতে রইল ‘টি’ আর ‘পি’: টিচার্স পার্টি! যদি রাজনীতি বলেন, এটাই রাজনীতি সব শিশুকে ভাল করে পড়াবার রাজনীতি!’
এটাও পশ্চিমবঙ্গ। |