প্রবন্ধ ২...
সরকার স্বল্প সঞ্চয় ব্যাঙ্কে পৌঁছে দিক
গ্নি সংস্থার দুরাচার সরকারের সামনে এক বিশাল সমস্যা সৃষ্টি করেছে। কেন্দ্র-রাজ্য সব স্তরেই এ ধরনের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রচুর আলোচনা শুরু হয়েছে। কিন্তু অর্থনীতির সমাধানসূত্র নিয়ে তেমন কোনও আলোকপাত করা হচ্ছে না। সরকারের এটা করা উচিত বা ওটা করা উচিত নয় এ ধরনের মন্তব্যের মধ্যে অনেক ‘সহানুভূতি’, ‘মানবিকতা’, মানুষের চোখের জল মোছানোর প্রবৃত্তি লুকিয়ে থাকে। ঘটনা হল, একমাত্র অর্থনীতিই এই সমস্যার সমাধানসূত্র জোগাতে পারে। কিন্তু সেই অর্থনীতিকে বোঝার মতো এবং কার্যকর করার মতো বুদ্ধি, রাজনৈতিক ইচ্ছে ও ক্ষমতা সবই প্রয়োজন। এই প্রসঙ্গে বিশেষ করে সরকার আয়োজিত, কিন্তু সরকার পরিচালিত নয় এমন স্বল্প সঞ্চয় সংস্থার বিশেষ প্রয়োজন নিয়ে আলোচনা হওয়া বাঞ্ছনীয়। অধুনা আলোচিত রাজ্য সরকারের উদ্যোগের পিছনে সঠিক অর্থনীতির প্রয়োগ এবং তজ্জনিত সদিচ্ছার প্রসঙ্গও আলোচিতব্য। তার আগে কতকগুলো ধারণা স্পষ্ট করে নেওয়া প্রয়োজন।
আমি ঝুঁকি নিয়ে, বেশি সুদের আশায় ঘটি-বাটি বন্ধক রেখে বিনিয়োগ করলে এবং সে বিনিয়োগ মার খেলে সরকারের কোনও দায় থাকার কথা নয়। সরকার সেই আর্থিক দায় বহন করা মানে যাঁরা ওই ঝুঁকি নেননি বা যাঁরা সরকারকে কর দিয়েছেন, তাঁদের উপর দিয়ে অন্যদের ঝুঁকির ঠেলা সামলানো। এটা অর্থনৈতিক ভাবে এবং নৈতিক ভাবে অন্যায়।
যে সব কোম্পানি ঝুঁকির পরিমাণ লুকিয়ে রেখে, নিয়মবিরুদ্ধ, আইনবিরুদ্ধ ব্যবসা করছে, তাদের গণেশ ওল্টানো সরকারের নৈতিক কর্তব্য। মানুষকে সতর্ক করে, সাবধান করে এটাই বলা উচিত যে, খারাপ সময় উপস্থিত হলে কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসবে না। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ভারতবর্ষে গ্রামাঞ্চলে অনেক ঘোষিত নীতি কার্যকর হয় না, কারণ সরকারি তরফে মানুষকে সে সব বিষয়ে সচেতন করার জন্য কোনও চেষ্টাই করা হয় না। সরকারের তরফে মানুষকে সচেতন করা এবং সতর্ক করা ভীষণ প্রয়োজন। তার পর মানুষের নিজের বিচারবুদ্ধির ওপর ব্যাপারটা ছেড়ে দেওয়া ভাল।
দুষ্টের দমন? মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী। এপ্রিল ২০১৩। ছবি: সনৎ কুমার সিংহ
পশ্চিমবঙ্গে সমবায় ব্যবস্থা তেমন সাফল্য লাভ করেনি, যেমন সাফল্য লাভ করেছে ভারতের অন্য কিছু জায়গায়। সরকারি সমবায় ব্যাঙ্কগুলো সরকারের বিনিয়োগে আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালে, আর ছোটখাটো ব্যবসায়ীরা সেখানে ঋণ পান না এ গল্পও আমরা জানি।
অর্থনীতিকে প্রাকৃতিক নিয়মে মৃত্যুর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোনও সময়ে পালে হাওয়া লেগেছে বলে একসঙ্গে একগাদা ব্যবসায়ী একটি ব্যবসা চালু করতে পারে, কিছু দিন বাদে সবাই টিকে থাকতে পারবে না, কারণ ব্যবসায় মন্দা দেখা দিলে যার জোর যত বেশি, যে দক্ষ, সে-ই টিকে থাকবে। এই ভাবে অনেক দিন ধরে বিবর্তনের ফলে একটা স্থিতিশীল সংখ্যক ব্যবসায়ী সেই ব্যবসা চালাবেন, ভুঁইফোঁড়রা আসবে যাবে। এটাই যথাযথ বিবর্তনের পথ। দু’চারটে সংস্থা সর্বস্বান্ত হলে তবেই আমরা এ ধরনের সংস্থায় বিনিয়োগ করতে দশ বার ভাবব। মানুষকে বোকা বানানো তুলনায় কঠিন হবে। সে কারণে মাঝেসাঝে আর্থিক সংকটেরও প্রয়োজন আছে।
স্বল্প সঞ্চয়কে পুনরুজ্জীবিত করার উপায় একটাই। প্রত্যন্ত জায়গায়, যেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলো শাখা খুলতে অনিচ্ছুক, সেখান থেকে সঞ্চয় সংগ্রহ করে ব্যাঙ্কগুলোতে বিনিয়োগ করা। একটি বা কয়েকটি ব্যাঙ্কের পক্ষে ছোট পরিমাণ সঞ্চয় একত্র করে বিনিয়োগ করা মুনাফাসাপেক্ষ নয়। সে ক্ষেত্রে সরকার স্বল্প সঞ্চয় সংগ্রহ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে রাখতে পারে এবং ব্যাঙ্কগুলো সেই সঞ্চয়ের সদ্ব্যবহার করে অন্যান্য সঞ্চয়কারীদের যেমন সুদ দেয়, তেমনি হারে সুদ দিতে পারে। যেহেতু সামগ্রিক ভাবে স্বল্প সঞ্চয়ের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেন্দ্র-রাজ্য দুই সরকারের যৌথ ভূমিকাগ্রহণে এই স্বল্প সঞ্চয় সংগ্রহ অভিযান চালু হতে পারে। অর্থাৎ, সরকারের যদি খরচা করতেই হয়, তা হলে স্বল্প সঞ্চয় সংগ্রহ অভিযানে বা সংগ্রহ প্রকল্পে খরচা করা উচিত এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর সঙ্গে মানুষের, গ্রামের একটা সেতুবন্ধনের ব্যবস্থা করা উচিত। বর্তমানে এই রাজ্যে যে সরকারি সঞ্চয় প্রকল্পের কথা বলা হয়েছে, সেই প্রকল্পও স্বল্প সঞ্চয় সংগ্রহ অভিযানের মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর সঙ্গে সেতুবন্ধনের মারফত হতে পারে। সরকারের নিজে বিনিয়োগ করার কোনও প্রয়োজন নেই। সরকার নিজে স্বল্প সঞ্চয় সংগ্রহ করে বিনিয়োগ করলে আদৌ মুনাফা করবে কি না, সুদ দিতে পারবে কি না, সে বিষয়ে রীতিমত সংশয় আছে। ঋণ দেওয়া-নেওয়াতে ব্যাঙ্কিং প্রতিষ্ঠানগুলো দক্ষ এবং সিদ্ধহস্ত। মানুষের স্বল্প সঞ্চয় ব্যাঙ্কে পৌঁছলে এবং একলপ্তে অনেকটা সঞ্চয় একসঙ্গে পেলে ব্যাঙ্কগুলোও খানিকটা ভাল সুদ দিতে পারবে। পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমে এই সঞ্চয় সংগ্রহ অভিযান প্রকল্প চালু হতে পারে। অর্থাৎ, সরকার শুধু সেতুবন্ধনের কাজ করবে। অন্য ভাবে বলা যায়, সরকার হবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর এজেন্ট। সে ক্ষেত্রে রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার কমিশনও পেতে পারে। রাজ্য সরকার ও ব্যাঙ্কগুলোর মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করা যায়, রাজ্যের সংগৃহীত স্বল্প সঞ্চয় থেকে রাজ্য সরকার কী ধরনের সুবিধে পাবে এবং ব্যাঙ্কগুলোর মুনাফা কী ভাবে হবে। ব্যাঙ্কিং একটি ব্যবসা। দারিদ্র মোচনের প্রত্যক্ষ হাতিয়ার হিসেবে একে ব্যবহার করা উচিত নয়।
এ নিয়ে আরও আলোচনা এবং চিন্তা আবশ্যক। মনে রাখতে হবে, মানুষের কাছে পৌঁছনোটাই বড় ব্যাপার। আর শুভস্য শীঘ্রম। দু’দিন বাদে আবার আমরা অতীতের ইতিহাস একেবারে বেমালুম ভুলে যাব, এটাই স্বাভাবিক।
পরিশেষে একটা কথা বলি। নীতি ও আদর্শ এই দু’টি কথা সফল রাজনীতির পরিসরে খুঁজে পাওয়া যায় না। দুর্নীতিতে জর্জরিত রাজনীতির মানুষেরা অনেকেই ভীষণ সফল। এঁদেরই আমরা আমাদের শাসন করার দায়িত্ব দিই, স্বেচ্ছায়। সফল রাজনীতি ও অর্থনৈতিক দুর্নীতির সম্পর্ককে বাদ দিয়ে কিছু ভাবা অত্যন্ত কঠিন। তবু নীতি ও আদর্শের কথা বারে বারে কাউকে-না-কাউকে বলতে হবেই। মানুষ নিশ্চয় সৎ, নীতিবাদী, আদর্শবান রাজনীতিবিদকে দেখতে চায়, সম্মান করতে চায়, অন্যদের চেয়ে কোথাও একটা তফাত করতে চায়। এমন রাজনীতির মানুষ বিরল। কিন্তু এখনও নেই এমন নয়। তাঁদের ভাবমূর্তি কলঙ্কের মধ্যে ছিটেফোঁটা চাঁদের মতো। এমন নেতা দু-এক জন থাকবেন, এটাই আমাদের বড় পাওনা। কিন্তু তাঁদের হয়তো রবীন্দ্রনাথের কথাটা মেনে চলা বাঞ্ছনীয়। তৃণসম দহনের জ্বালাকে ভয় পাওয়াটাও ওই আদর্শেরই অঙ্গ। দুর্নীতিপরায়ণ না হয়েও দুর্নীতি সহ্যের একটা গ্লানিবোধকে তাঁরা গুরুত্ব দেবেন, এটাই প্রত্যাশিত। বিশেষত অর্থনৈতিক দুর্নীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত যে কোনও মানুষকে শাস্তি দিতে তাঁরা দ্বিধাবোধ করবেন না, এটাই নীতি বা আদর্শের শেষ কথা।

কলকাতায় সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতিবিদ।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.