|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
বাণিজ্য বাড়লেই অবশ্য বন্ধুত্ব আসে না
অর্থনীতির যোগাযোগ যত বাড়ে, ততই ভাল। কিন্তু ‘হিন্দি-চিনি ভাই ভাই’-এর যুগ
বহু কাল আগে অতিক্রান্ত, এই বাস্তবতার মাটিতে পা রেখে এগোনোই ভারতের পক্ষে শ্রেয়।
সব্যসাচী বসুরায়চৌধুরী |
স্বস্তি এল ঘরে? এমন ভাবেই কি বর্ণনা করা চলে চিনের নতুন প্রধানমন্ত্রী লি খ্যছিয়াং-এর ভারত-সফরকে? এই বছরের গোড়ায় দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই যে এই সফর! তাঁর প্রথম বিদেশ-সফর। আর এই সফরের অল্প আগেই এপ্রিলের মাঝামাঝি কিনা লাদাখের দেপসাং উপত্যকা থেকে ভেসে আসা খবর যথেষ্ট ত্রস্ত করে তুলেছিল নয়াদিল্লিকে? চিন-ভারত সীমান্তে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা ছাড়িয়ে অন্তত বারো মাইল ভিতরে চলে আসে চিনা সেনারা। দিব্যি তাঁবু খাটিয়ে বসে পড়ে সেখানে। অথচ প্রধানমন্ত্রী লি-র সফরের প্রাক্কালে, সাউথ ব্লকের দৌত্যে, সেই অনাহূতরাই দিব্যি মিলিয়ে গেল ভোজবাজির মতো। এতেও স্বস্তি নয়?
|
বাণিজ্যে বসতে... |
পরিসংখ্যান বলছে, ২০১২-১৩ আর্থিক বছরে ভারত ও চিনের মধ্যে মোট দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ৬,৮০০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের। এর এক দশক আগে এই দুই দেশের মধ্যে যে পরিমাণ ব্যবসায়িক লেনদেন হত, তার চাইতে অন্তত তিরিশ গুণ বেড়েছে এই বাণিজ্য। বস্তুত, ২০১১-১২ সালে ভারত-চিন বাণিজ্যের মোট পরিমাণ ৭,৫০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি পৌঁছয়। তার পরে আন্তর্জাতিক আর্থিক মন্দার জেরে বিশ্ব জুড়ে বিক্রিবাটা বেশ কমেছে, এই দু’দেশের বাণিজ্যে তার প্রভাব পড়েছে।
বস্তুত, ১৯৭৮ সাল থেকে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ফের চালু হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যে ১৯৮৪ সালে ভারত ও চিন বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে পরস্পরকে ‘সর্বাধিক সুবিধাপ্রাপ্ত দেশ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এর পরেও ২০০০ সাল পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে বার্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল মাত্র ৩০০ কোটি ডলারের মতো। এর বছর আটেকের মধ্যে এই বাণিজ্যের পরিমাণ এতটাই বাড়ে যে, আমেরিকাকে ছাপিয়ে চিন অচিরে ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্যিক সঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়। |
|
বন্ধু? লি খ্যছিয়াং ও মনমোহন সিংহ, দিল্লি, ২০ মে, ২০১৩। ছবি: এ এফ পি |
এর পরেই শুরু বিশ্ব আর্থিক মন্দা। সেই পরিপ্রেক্ষিতে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য কিছুটা কমেছে। অন্য দিকে, বেজিং অলিম্পিকের আগে পর্যন্ত চিনের পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বিপুল হারে বেড়েছিল। অলিম্পিকের পরে পরিস্থিতি বদলেছে। তাই সে দেশে ভারতের রফতানির পরিমাণও কমে। উল্লেখ্য, নিজেদের বার্ষিক আর্থিক উৎপাদনের হার ধারাবাহিক ভাবে বহু বছর যাবৎ রীতিমত তাক-লাগানো দশ শতাংশের উপরে ধরে রাখতে পারলেও ইদানীং মন্দার প্রেক্ষিতে চিন তা সাড়ে সাত শতাংশে রাখতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। অন্য দিকে, ভারতের অবস্থা তো চিনের থেকেও করুণ।
পাশাপাশি আরও দুটি বিষয় লক্ষণীয়। প্রথমত, ভারত ও চিনের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়লেও পাল্লা কিন্তু যথেষ্ট ভারী চিনের দিকেই। চিনের সাপেক্ষে ২০১২-১৩ সালে ভারতের মোট বাণিজ্যিক ঘাটতির পরিমাণ ছিল অন্তত চার হাজার কোটি ডলার। দ্বিতীয়ত, এই বাণিজ্যে এক ধরনের ঔপনিবেশিকতার ছায়া এখনও প্রকট। ভারত চিনে এ যাবৎ যা রফতানি করে এসেছে, তার অধিকাংশই আকরিক লোহা-সহ নানা ধরনের কাঁচামাল। সরকারি ও বেসরকারি ভারতীয় সংস্থাগুলি চিনে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে, তা এখনও নিতান্তই অপ্রতুল। কর সংক্রান্ত নানা জটিলতাতেও তারা বেশ জর্জরিত। চিনা প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় এই বিষয়ে কিছু প্রতিশ্রুতির কথা শোনা গেলেও তা সংশ্লিষ্ট মহলে কতটা আশা জাগাতে পেরেছে, বলা মুশকিল। প্রধানমন্ত্রী লি অবশ্য ‘হিমালয়ের উপর দিয়ে করমর্দন’-এর প্রস্তাব দিয়ে জানিয়েছেন যে, পৃথিবীর দুই সর্বাধিক জনবহুল দেশ তাদের পুরনো বৈরিতা ভুলে পরস্পরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিশ্ব অর্থনীতির এক নতুন চালিকা শক্তি হয়ে উঠতে পারে।
|
চিন-পাক দোস্তি জিন্দাবাদ |
এক দল বিশেষজ্ঞ দাবি করেন, ক্রমান্বয়ে আর্থিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পেলে দুই বৈরী দেশের মধ্যে অপেক্ষাকৃত জটিল ও স্পর্শকাতর বিষয়গুলি হয় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়তে থাকে, অথবা সেগুলির সমাধানের সূত্র পাওয়া যায়। ভারত ও চিনের ক্ষেত্রে তা কতটা সম্ভব, বা আদৌ সম্ভব কি না, সময় নিশ্চয়ই তার জবাব দেবে। তবে এখনও সে সম্ভাবনা তেমন উজ্জ্বল নয়।
কিছু বছর আগেও পশ্চিমি রাষ্ট্রনেতারা উপমহাদেশ সফরে এলে ভারতের পাশাপাশি পাকিস্তান বা পাকিস্তানের পাশাপাশি ভারত-সফর সেরে নিতেন। স্বাধীনতার চার-পাঁচ দশক পরেও ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে হাইফেনটি এতটাই উজ্জ্বল ছিল। পশ্চিম দুনিয়ার চোখে এই হাইফেনটি এখন প্রায় মিলিয়ে গেছে। কিন্তু চিনের ক্ষেত্রে সেটা বলা যাবে না। ভারত-সহ অন্তত পাঁচটি দক্ষিণ এশীয় দেশের সঙ্গে চিনের সীমানা থাকলেও পাকিস্তান বহু বছর ধরেই বেজিং-ঘনিষ্ঠ। ইসলামাবাদে সেনা শাসন বা গণতন্ত্র কোনওটাতেই এই ঘনিষ্ঠতায় ভাটা পড়েনি।
ফিরতি পথে প্রধানমন্ত্রী লি নয়াদিল্লি থেকে পাকিস্তানে গিয়ে সেই কথা পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। চিন ও পাকিস্তানের বিকাশ যে অবিচ্ছেদ্য, তা চিনা নেতার কথায় অত্যন্ত স্পষ্ট। প্রসঙ্গত, তীব্র বিদ্যুৎ সংকট পাকিস্তানের কলকারখানার উৎপাদনে সমস্যা তৈরি করেছে। এরই জেরে বহু লোক রোজগার হারানোর ফলে দারিদ্র তীব্রতর হয়েছে। ভ্রাতৃঘাতী হামলা ও তালিবানি হিংসাও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রী লি-এর সফরকালে প্রস্তাবিত চিন-পাকিস্তান যৌথ আর্থিক করিডর এই ক্ষতে প্রলেপ লাগানোর পক্ষে যথেষ্ট।
এর ফলে পাকিস্তানের সুবিধার পাশাপাশি চিনের সুবিধাও প্রশ্নাতীত। পাক-নিয়ন্ত্রণাধীন জম্মু-কাশ্মীরের গিলগিট-বালটিস্তান এলাকার মাধ্যমে চিন-নির্মিত কারাকোরাম মহাসড়কের প্রসার চিনের জিনজিয়াং প্রদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের নতুন গ্বদর বন্দরের সংযোগ সুনিশ্চিত করবে। তা ছাড়া, এর ফলে পাকিস্তানের মাধ্যমে পশ্চিম চিনের অপেক্ষাকৃত দুর্গম এলাকার সঙ্গে আরব সাগরের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের দেশগুলির যোগাযোগও বাড়বে। বেজিং এই ফেব্রুয়ারিতেই কার্যত গ্বদর বন্দরটির পরিচালন ভার নিজের হাতে নিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই এবং পাক বিদেশ সচিব জলিল আব্বাস গিলানির মধ্যে স্বাক্ষরিত সাম্প্রতিক সমঝোতাপত্র অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
২০১৫-র মধ্যে ভারত-চিন বাণিজ্যের পরিমাণ প্রস্তাবিত দশ হাজার কোটি ডলার ছুঁলেও চিন-পাক দোস্তি অটুটই থাকবে। উল্লেখ্য, পাকিস্তানকে চিনের ‘লৌহভ্রাতা’ বলে উল্লেখ করে লি একটি প্রাচীন চিনা প্রবাদের অবতারণা করেছেন দাবা খেলার সঙ্গীদের বন্ধুত্ব বড় জোর এক দিনের, নৈশভোজের সঙ্গীর ক্ষেত্রে তা মাসখানেকের, ক্ষমতা আর প্রভাবের জেরে যে বন্ধুত্ব, তার আয়ু খুব জোর এক বছর, সেখানে অভিন্ন মূল্যবোধের জোরে গড়ে ওঠা বন্ধুত্ব সারা জীবনের। লি উবাচ, চিন আর পাকিস্তানের বন্ধুত্ব সেই অভিন্ন মূল্যবোধের। আর তাই এটা এক জীবন নয়, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পার করে চিরন্তন। এহ বাহ্য! ‘হিন্দি-চিনি ভাই ভাই’-এর যুগ অতিক্রান্ত এই বাস্তবতার মাটিতে পা রেখে এগোনোই কিন্তু ভারতের পক্ষে শ্রেয়। ভুললে চলবে না, চিনা কমিউনিস্ট পার্টির পঞ্চম প্রজন্মের এই নেতা লি আগামী এক দশক চিনের
নেতৃত্ব দেবেন।
|
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত। |
|
|
|
|
|