বানপ্রস্থে যাইবার বয়সে প্রৌঢ়প্রৌঢ়াদের নিজেদের অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা করিতে হইতেছে। পশ্চিমবঙ্গ-সহ ভারতের সাতটি রাজ্যের এক সমীক্ষায় দেখা গিয়াছে, সত্তর শতাংশ বয়স্ক মানুষ অনিচ্ছা সত্ত্বেও কাজ করিতে বাধ্য হন। তাহার একটি বড় কারণ, তাঁহাদের বেশির ভাগই সন্তানদের উপার্জনের উপর নির্ভরশীল ছিলেন, এখন সন্তানরা ব্যয় বহন করিতে অস্বীকার করিতেছে। বাকিদের দায়িত্ব লওয়ার কেহ নাই। অগত্যা। এমন পরিস্থিতির পিছনে নানা কারণ থাকে। কিন্তু একটি বড় কারণ অনুমান করা কঠিন নয়। পূর্বে একান্নবর্তী পরিবার ছিল। বয়স্কদের প্রতি পরিবারের অন্যদের স্বাভাবিক দায়বোধ ছিল। বর্তমানে একান্নবর্তী পরিবার লুপ্তপ্রায়। পরিবার পিছু সন্তান একটি বা দুইটি। তাহারা উচ্চশিক্ষায় বা নিজ কর্মে ব্যস্ত। উপরন্তু প্রায়শই দায়িত্ব বহনে আগ্রহীও নহে। অতএব বয়স্ক মানুষেরা কাজ করিতে বাধ্য হইতেছেন। সমীক্ষাও বলিতেছে, সন্তানরা অনেক ক্ষেত্রেই বাবা-মাকে কাজ করিতে বাধ্য করিতেছে।
প্রশ্ন উঠিতে পারে, বয়স্ক অভিভাবকদের সব দায় কি কেবল সন্তানের? বাবা-মা সন্তানকে ছোটবেলায় তো বটেই, এমনকী অনেক সময়েই প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও প্রতিপালন করিয়া থাকেন, যত দিন না তাহারা স্বোপার্জনে সমর্থ হয়। অতএব মা-বাবা অশক্ত হইবার পর সন্তান তাঁহাদের ভরণপোষণের ভার লইবে, ইহা এক অর্থে স্বাভাবিক যুক্তি। কিন্তু কোনও সন্তান যদি দায়িত্ব লইতে অস্বীকার করে, তাহার উপর জোর করিয়া মাতাপিতার দায়িত্ব চাপাইয়া দেওয়া যায় কি? গণতন্ত্রে এক জন নাগরিকের যে স্বাধিকার স্বীকৃত, ইহা কি তাহাকে লঙ্ঘন করে না? তাহা হইলে উপায়? অনেকেই বলিবেন, উপায় রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের নিকট দেশের নাগরিক হিসাবে প্রতিপালনের আর্জি জানানো যাইতে পারে, রাষ্ট্র তাহার বয়স্ক নাগরিকদের প্রতি মুখ ফিরাইয়া লইতে পারে না। কিন্তু এই যুক্তিও কি বাস্তবসম্মত? সামর্থ্যের প্রশ্ন তো আছেই, আরও মৌলিক প্রশ্ন নীতির। পরিবারের তথা সমাজের দায় রাষ্ট্রের উপর কতটা চাপানো উচিত?
মানিতেই হইবে, এই প্রশ্নের সদুত্তর বিপন্ন বয়স্ক মানুষদের পক্ষে অপ্রিয়। কিন্তু ইহাও অনস্বীকার্য যে, এই সমস্যার সমাধান সমাজকেই খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে। মাতাপিতা বয়সকালে সন্তানের উপর নির্ভরশীল থাকিবেন, ইহাই ছিল ভারতীয় সমাজের রীতি। পরিবর্তন ও বিবর্তনের মধ্য দিয়া সমাজ অনেক নূতন রূপ ও নূতন রীতির জন্ম দিয়াছে। তাহার একটি প্রতিফলন হইতেছে মাতা-পিতা-বয়স্কদের নিঃসঙ্গতায়। এই নিঃসঙ্গতা কেবলমাত্র মানসিক পীড়ার কারণ হইয়া থাকে নাই, নিজেদের ভরণপোষণের দায়িত্বও অনেকের পক্ষেই দুর্বহ করিয়াছে। কিন্তু আইন করিয়া বা বাহির হইতে কোনও নিয়ম-নীতি চাপাইয়া এই সমস্যার সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব নহে। সমাধানের পথটি কী, তাহা আগে হইতে নির্ধারণ করাও সম্ভব নহে। পরিবর্তন ও বিবর্তনের মধ্য দিয়াই তাহা খুঁজিতে হইবে। সমাজের কাজ, সমাজেরই। |