সায়ন্তন মজুমদার সচিত্র চিঠিতে (‘আজও সেই...’, ১৩-৫) জানিয়েছেন, মুর্শিদাবাদে এখনও কমলেকামিনী পুজো হয়। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, দেবী দু’হাতে দু’টি শ্বেতহস্তী ধরে আছেন। নীচে দু’পাশে জয়া ও বিজয়া। মুকুন্দ বর্ণিত কমলেকামিনীর হুবহু প্রতিরূপ এটি নয়। কিছু পরিবর্তিত। ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এ তাঁর রূপ ভয়ঙ্করী: ‘উগারিয়া মত্ত করি ধরে বাম করে’।
দেবী চণ্ডিকা বা চণ্ডীর এই মূর্তিপুজো মুকুন্দের অনেক আগে থেকেই রাঢ়ভূমিতে প্রচলিত ছিল। বাঁকুড়া-পুরুলিয়ায় জৈনদের প্রতিষ্ঠিত বা নির্মিত শক্তিদেবীর বেশ কিছু মূর্তির সন্ধান মিলেছে, যেগুলি অন্তত হাজার দেড় হাজার বছরের পুরনো। তাঁরা রণসাজে সজ্জিতা, ‘রণং দেহি’ ভাব। হস্তিমর্দিনী বা হস্তিবিনাশিনী। পদতলে দু’পাশে দু’টি ক্ষুদ্রাকৃতি নারীমূর্তি দণ্ডায়মানা। এখনও এঁদের দুর্গা ও পার্বতী জ্ঞানে পুজো করেন ভূমিজ কোড়া ও মুড়ারা। যেমন, বাঘমুণ্ডির হারুপ, দেউলি, রাইপুরের গড়ে প্রতিষ্ঠিতা মহামায়া। রাইপুরের মহামায়া কোকমুখা, দক্ষিণী স্টাইলে বস্ত্র পরিহিতা। মত্ত হাতিকে বধ করছেন। পুরোহিত বলেন, হাতিটি করিন্দাসুর। আসলে এটি দ্রাবিড়ি দুর্গা বা চণ্ডিকা। আনুমানিক দশম শতকের শিলামূর্তি। পুজোয় বংশপরম্পরায় স্থানীয় শবর ও ভূমিজরা আজও জড়িত। দেউলির হস্তিবিনাশিনী মূর্তিটিও জৈন দেবী। এখন রণচণ্ডিকা জ্ঞানে স্থানীয় সিংমুড়ারা এটি পুজো করেন। একই মূর্তি পাতকুমে রয়েছে। চণ্ডীমঙ্গলের কমলেকামিনী রূপটির সঙ্গে এঁদের গভীর সাদৃশ্য। জৈনরা দেবী কমলারও পুজো করতেন। তার প্রমাণ, প্রচুর জৈন দেবালয় সংলগ্ন জলাশয়ের নাম কমলা বা কমলে পুকুর (বাঁকুড়ার টানে ‘কমল্যা’)।
একাদশ দ্বাদশ শতক পর্যন্ত পশ্চিম রাঢ়ের জনজাতির মানুষ জৈনধর্মী ছিলেন। মঙ্গলকাব্যগুলিতে পৌরাণিকতার সঙ্গে লৌকিকতার সমন্বয় ঘটেছে। বাঁকুড়ার গন্ধবণিক সমাজ ধনপতির দুর্ভোগ ও সুখভোগ স্মরণ করে আজও একটি ব্রত পালন করেন। তার নাম— সুয়ো-দুয়ো
ব্রত। কলাখোলে নৌকা বানিয়ে দুর্গাপুজোর আগে এ ব্রত পালিত হয় বাণিজ্যযাত্রা থেকে ভাল ভাবে বাড়ি ফিরে আসার কামনায়।
অরবিন্দ চট্টোপাধ্যায়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, বাঁকুড়া খ্রিস্টান কলেজ |