ভারত-জাপান এক নতুন যাত্রাপথ রচনা করতে টোকিওয় দুই প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এবং শিনজো আবের বৈঠক চলছে। আর বাইরে তখন মাইক নিয়ে এক দল মানুষ তুমুল চেঁচামেচি করে চলেছে। বাইরে এসে দেখি, প্রতিরক্ষা সামগ্রী রফতানি বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন জাপানের কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা। মনে পড়ল, ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তি নিয়ে আলোচনার সময় যন্তরমন্তরে এ ভাবেই বিক্ষোভ দেখাতেন প্রকাশ কারাটের নেতৃত্বাধীন ভারতের কমিউনিস্টরা। এ দিন বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে দু’দেশ ঘোষণা করল, আমেরিকা ও ফ্রান্সের পরে জাপানও অসামরিক পরমাণু চুক্তি করতে চলেছে ভারতের সঙ্গে।
মনমোহনের পক্ষে এই সাফল্য কম নয়। হিরোশিমা-নাগাসাকির পর পরমাণু প্রতিরক্ষা নিয়ে প্রবল এক যুদ্ধ-বিরোধী অবস্থান নেয় টোকিও। এত বছর পরে কিন্তু সেই জাপানও বদলাচ্ছে। এত দিন তারা বলে এসেছে ভারত পরমাণু অস্ত্র-প্রসার রোধ চুক্তি (এনপিটি)-তে সই করলে তবেই তারা চুক্তির কথা ভাবতে পারে। আজকের বৈঠকে আবে সেই প্রসঙ্গই তোলেননি। উল্টে যৌথ বিবৃতিতে ভারতের পরমাণু সম্প্রসারণ বিরোধী অবস্থানের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে।
আসলে জাপানও এখন বুঝছে, চিন যে ভাবে পূর্ব চিনা সাগরে আগ্রাসী হয়ে উঠছে, তাতে ভারতকে পাশে পাওয়াটা তাদের খুবই দরকার। তার পর নতুন অর্থনৈতিক মডেল করতে গিয়ে একটা বড় ঝুঁকি নিয়েছে আবে সরকার। সরকারের খরচ বেড়ে গিয়েছে প্রায় দশ হাজার কোটি ডলার। বাড়ছে মূল্যবৃদ্ধিও। সব মিলিয়ে সরকারের অর্থনৈতিক অবস্থান মোটেই ভাল নয়। ১২ কোটি মানুষের দেশ জাপানে বেকারি বাড়ছে।
এই সার্বিক প্রেক্ষাপটেই কি এ বার প্রোটোকল ভেঙে মনমোহন সিংহকে কিছুটা বাড়তি খাতির করল জাপান?
গত কাল আবে মনমোহনকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে খাইয়েছেন। জাপানি সুশির পাশাপাশি ডাল-ভাতের ব্যবস্থাও ছিল। দেশের সাংবিধানিক প্রধান যিনি, সেই জাপানের সম্রাট আজ মনমোহনকে ইম্পিরিয়াল প্যালেসে নিমন্ত্রণ করে মধ্যাহ্নভোজ খাওয়ালেন। জাপানের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তোমোহিকো তাংগিগুচি ভারতের মিডিয়া সেন্টারে এসে গল্প করে গেলেন। জাপানের প্রধানমন্ত্রীর অফিসের এক কর্তা তাজ্জব হয়ে জানাচ্ছেন, “জাপান এক ভয়ানক রকম ‘তাসের দেশ’। এ ভাবে প্রোটোকল ভেঙে মধ্যাহ্নভোজ, আগে দেখিনি!” ওই কর্তাই জানালেন, নভেম্বরের শেষে সম্রাট দিল্লি সফরে আসছেন। |
জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মনমোহন সিংহ। ছবি: রয়টার্স |
পরিকাঠামো ক্ষেত্রেও ঢালাও ঋণের পসরা নিয়ে তৈরি জাপান। মুম্বই মেট্রো লাইনের ৩টি প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ হল ৭১০০ কোটি ইয়েন ঋণ। হায়দরাবাদ আইআইটি প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্য ১৭০৭ কোটি ইয়েন, তামিলনাড়ু বিনিয়োগ প্রকল্পের জন্য ১৩০০ কোটি ইয়েন বরাদ্দ হয়েছে। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনর্গঠনেও জাপানি ঋণ মিলছে। মুম্বই-আমদাবাদ লাইনে হাইস্পিড ট্রেন লাভজনক হবে কি না দেখতে আসছে জাপানের বিশেষজ্ঞ দল। তবে পশ্চিমবঙ্গের নামগন্ধও নেই এই তালিকায়।
আজ আরও একটি বড় কূটনৈতিক জয় ছিনিয়ে নিয়েছে ভারত। ভারতকে ‘ইউ এস-২ অ্যাম্ফিবিয়ান’ যুদ্ধবিমান বিক্রি করতে রাজি হয়েছে জাপান। বিদেশ মন্ত্রকের বক্তব্য, এটি নিঃসন্দেহে একটি খুবই বড় ঘটনা। প্রযুক্তির শীর্ষে থাকা এই বিমান বিক্রি তো দূরের কথা, জাপান চট করে অন্য দেশকে দেখাতেও চায় না। বিদেশসচিব রঞ্জন মাথাই আজ সাংবাদিকদের বলেন, “এই উভচর জাপানি বিমান প্রচণ্ড শক্তিশালী এবং এর পাল্লাও খুই বেশি। সামরিক এবং অসামরিক দু’ক্ষেত্রেই এই বিমান ব্যবহার করা যায়।”
প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে রফতানির দরজা খুলে দিয়ে আবে অবশ্যই একটি বড় ঝুঁকি নিয়েছেন। কারণ শুধু কমিউনিস্ট পার্টিই নয়, জাপানের জনসমাজে এখনও যুদ্ধ-বিরোধী মানসিকতাই গেড়ে বসে রয়েছে। ২১ জুলাই সে দেশের সংসদের উচ্চকক্ষে আবে সরকার তাই সংবিধান সংশোধন করতে নতুন বিল আনছে। যার মূল লক্ষ্য, অতীতের বিধিনিষেধ কাটিয়ে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে জাপানের কেনাবেচা বাড়ানো। জাপানি নেতৃত্বের বক্তব্য, তাঁরা প্রযুক্তিতে বিশ্বসেরা। পরমাণু ক্ষেত্রে সুরক্ষাও তাই তাঁরাই সবচেয়ে ভাল দিতে পারবেন। প্রতিরক্ষা সামগ্রীর বাজারেও জাপানি পণ্য অনায়াসে বিক্রি হয়ে দেশকে প্রচুর ডলার এনে দেবে। তবে ভারত এবং জাপানের মধ্যে যে পরমাণু চুক্তির বিষয়ে আলোচনা হয়েছে তার কোনও সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়নি। একটি যৌথ স্টাডি গ্রুপ তৈরি করার সিদ্ধান্ত হয়েছে, যারা চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়টি দেখাশোনা করবে। যৌথ নৌ মহড়া ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে দু’দেশের মধ্যে কেনা বেচা বাড়ানোর বিষয়টিও এই গোষ্ঠী পর্যালোচনা করবে। আসলে জাপানিদের মানসিকতা বদলের জন্য কিছুটা সময় নিতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী আবে। তাদের প্রতিরক্ষা-বাণিজ্য বিরোধী মনোভাবের বদল যে এক দিনে হবে না সে কথা তিনি ভালই জানেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্রের ইঙ্গিত, এই চুক্তি রূপায়িত হতে বছর দুয়েক লাগবে। কিন্তু কোন সরকার এই চুক্তি করবে তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ভাবছেন না। রাষ্ট্রনেতা হিসাবে তাঁর বক্তব্য, এই চুক্তির পিছনে ভারতের দায়বদ্ধতা রয়েছে।
আগামিকাল অসমের রাজ্যসভার নির্বাচনে মনমোহনের জয়ের সম্ভাবনা সুনিশ্চিত। তার আগে আজ টোকিওয় দু’দেশের যৌথ চুক্তিতে মনমোহনের আগাম হাসিটা কিন্তু প্রশস্তই হচ্ছে।
|
রেনকোজি বিতর্ক মেটাতে চায় দিল্লি
সংবাদসংস্থা • টোকিও |
জাপানের রেনকোজি মন্দিরে নেতাজির তথাকথিত অস্থিভস্ম নিয়ে বিবাদ মিটিয়ে ফেলতে চাইছে নয়াদিল্লি। এই নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে বুধবার বিদেশসচিব রঞ্জন মাথাই বলেন, “আলাপ-আলোচনা করে আমরা এই বিষয়টি সমাধান করতে চাই।” তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, সম্প্রতি দিল্লি হাইকোর্ট সরকারকে এই বিবাদ মিটিয়ে নিতে বলেছে। সে ব্যাপারে সরকারের কী অভিমত? মাথাইয়ের বক্তব্য, “এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নেতাজি সকলের কাছেই শ্রদ্ধেয়। কিন্তু আদালতের নির্দেশের প্রতিলিপি আমরা এখনও পাইনি। তা পেলে পর্যালোচনা করে দেখা হবে।” জাপানও এই বিবাদ মিটিয়ে নেওয়ার জন্য ভারতের উপর চাপ দিচ্ছে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী ভারতে এলেই দিল্লির কাছে এই প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন।
|