নিজের দেশের রাজনৈতিক রণাঙ্গনে দাঁড়িয়ে বোধ হয় এতটা সহজ হতে পারতেন না প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। নিজের ভিতরের টানাপোড়েনকে এ ভাবে প্রকাশ্য মঞ্চে উগরে দিতেও পারতেন না তিনি।
ভারতীয় অর্থনীতিতে উদারীকরণের পুরোহিত মনমোহন। আজ দুপুরে ভারত-জাপান বণিকসভার আলোচনাচক্রে সেই আর্থিক সংস্কারের রুদ্ধগতি নিয়েই নিজের যন্ত্রণা, নিজের বাস্তবতার কথা বলতে হল তাঁকে। সম্মেলনে উপস্থিত জাপানি ব্যবসায়ীদের অনিবার্য প্রশ্ন ছিল, মনমোহন কেন প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও গোটা দেশে এক ও অভিন্ন পণ্য পরিষেবা কর নীতি (জিএসটি) চালু করতে ব্যর্থ হলেন? উত্তরে মনমোহন স্পষ্ট বললেন, ২০১৪ সালে দেশে লোকসভা নির্বাচন। যে দল নতুন সরকার গঠন করবে, তারাই জিএসটি বাস্তবায়িত করবে। তার আগে করের আমূল সংস্কার সম্ভব নয়।
হতাশার এই বহিঃপ্রকাশের একটা বড় কারণ হল, মনমোহন এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, ‘আবেনমিক্স’-এর পৃষ্ঠভূমিতে। ১৯৯১ সালে যেটা ছিল ‘মনমোহনমিক্স’, দেশ কাল এবং প্রেক্ষিতের ভেদে জাপানে এখন তা-ই নামান্তরে ‘আবেনমিক্স’। জাপানে শিনজো আবে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর দক্ষিণপন্থী দল লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি চূড়ান্ত সংস্কারের পথে হাঁটছে। আর সেই সূত্রেই ভারতের সঙ্গে জমিয়ে ব্যবসা করতে চাইছেন আবে। কিন্তু ভারতে এখন সংস্কারের গতি শ্লথ। অভিন্ন পণ্য পরিষেবা কর, বিমায় বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ানো, পেনশন ক্ষেত্রে সংস্কারের মতো সমস্ত প্রয়াসই আটকে গিয়েছে রাজনৈতিক ঐকমত্যের অভাবে। বিদেশি বিনিয়োগের পথে বিশেষ করে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে এক-এক রাজ্যে এক-এক রকম করের কাঠামো। জাপানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, যদি ভারত সমস্ত রাজ্যে অভিন্ন কর চালু করতে পারে তা হলে জাপানি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের হার এক ধাক্কায় অনেক বেড়ে যাবে।
কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও এই মুহূর্তে কিছুই করতে পারছেন না মনমোহন সিংহ। তিনি আজ জানিয়েছেন, “২০১৪ সালের পর যে-ই ক্ষমতায় আসুক। জিএসটি হবেই। এটা যুগের চাহিদা। আমরাও চেয়েছিলাম এই ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হোক। কিন্তু এই করনীতি বাস্তবায়নের জন্য আরও আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্য প্রয়োজন।” জোট রাজনীতি এবং বিরোধী রাজনীতির চাপে পড়ে তাঁর সংস্কারমুখী কর্মসূচিগুলি যে একের পর এক মার খেয়েছে, সেটা তিনি আজ সহজ ভাষায় বাণিজ্যকর্তাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন। তবে কারও নাম করেননি। বরং নিজের বাধ্যবাধকতার দিকটিই তুলে ধরেছেন। তবে তিনি এখনও প্রত্যয়ী, ভারত ফের ৮ শতাংশ বৃদ্ধির রাস্তার ফিরবে।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে জাপানের মানুষ দ্ব্যর্থহীন ভাবে আজও মনমোহন সিংহকেই আর্থিক উদারীকরণের প্রতীক মনে করেন। আজকের এশিয়ায় এটাই বাস্তব যে, শিনজো আবে এবং মনমোহন সিংহ দু’জনেরই দু’জনকে প্রয়োজন। ভারতীয় শিল্পের আধুনিকীকরণে জাপানের ভূমিকা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করে মারুতি-সুজুকির সাফল্যের কথা মনে করিয়ে দেন মনমোহন। জাপানের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে পশ্চিম পণ্য করিডর এবং দিল্লি-মুম্বই বাণিজ্য করিডরের সপ্রশংস উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “জাপানের প্রযুক্তি এবং বিনিয়োগের প্রয়োজন ভারতের রয়েছে। চেন্নাই এবং বেঙ্গালুরুর মধ্যে শিল্প করিডরের মতো নতুন নতুন প্রকল্পের কথা ভাবছি আমরা। পরিবর্তে ভারতও তার অর্থনীতির দরজা খুলে দিয়ে জাপানের আর্থিক উন্নতিতে সহায়ক হয়ে উঠতে পারে।” কিন্তু এই সহযোগিতার চাকা যে অনেক ক্ষেত্রেই রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে ভারতের লাল ফিতের ফাঁসে এমন অভিযোগ মনমোহনের সামনে তুলতে কসুর করেননি জাপানি বাণিজ্য কর্তারা। সে দেশের এসএমবিসি ব্যাঙ্ক চলতি বছরে ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতে শাখা খুলেছে। কিন্তু তাদের বক্তব্য, কাজ করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, ভারতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বেশি। কাজের গতিও খুব শ্লথ। উত্তরে প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়েছেন, “জাপানের ব্যাঙ্ক ভারতের বিভিন্ন মেট্রো শহরে শাখা খুলবে এ অতি উত্তম কথা। কিন্তু আমাদের দেশে অর্থমন্ত্রক, রিজার্ভ ব্যাঙ্কই সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রণ করে।”
এ প্রসঙ্গেই তিনি তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বলেন, “অনেক সময়ই ‘সেরা’ কিন্তু ‘ভাল’র শত্রু হয়ে দাঁড়ায়। উঁচুতে উঠে গেলে অনেক সময় নীচের স্তরের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে যায়। সেটা হতে দেওয়া উচিত নয়।”
অর্থাৎ মনমোহন প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দিলেন, ভারতে সংস্কার ভারতীয় বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই করতে হচ্ছে তাঁদের। |