বারাক ওবামা টোকিও এসে জাপানের সম্রাটের সামনে ৯০ ডিগ্রি নত হয়ে সে দেশের কায়দায় অভিবাদন জানিয়েছিলেন। মার্কিনরা কূটনীতিতে নাটকীয়তা ভালবাসে। তাই সফরে গিয়ে জর্জ ডব্লিউ বুশ চুমু খান সৌদি রাজার গালে। এ সব নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। কিন্তু মার্কিন কূটনীতিদের একটি বড় অংশ বিশ্বাস করে, অনেক সময়ই কূটনীতিতে শরীরের ভাষা এমন কিছু কাজ করে দেয়, হাজার শীর্ষ বৈঠক যা করতে পারে না। এতটা নাটকীয়তা থেকে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ বরাবরই অনেক দূরে থাকেন। কিন্তু তিনিও ওবামার আত্মজীবনী সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের সময়। তাতে সই করিয়ে এনেছিলেন মেয়ের জন্য।
আজ টোকিওর হানিডা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উষ্ণ অভ্যর্থনা পাওয়ার পরে মনমোহনও কি জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় কোনও নাটকীয় কাণ্ড ঘটানোর কথা ভাবছেন? প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ কর্তা-ব্যক্তিরা বলছেন, সর্দারজির জীবনে নাটক ব্যাপারটি খুবই কম। টোকিওর এই সুদৃশ্য সন্ধ্যায় চারদিকে চেরি ফুলের সম্ভার দেখেও তাঁর মধ্যে উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশ নেই। শুধু জাপান সফর এক দিন বাড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। আর তাতেই দুনিয়াকে বার্তা দেওয়া গিয়েছে, সূর্যোদয়ের দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার তাগিদ তাঁর ষোলো আনার উপরে আঠারো আনা।
জাপান-ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক শুরু হয়েছিল ১৯৫২ সালে। কিন্তু অটলবিহারী বাজপেয়ীই প্রথম দু’দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে বৈঠককে ফি বছর করা বাধ্যতামূলক করে তুলেছিলেন। বাজপেয়ীর পরে প্রধানমন্ত্রী হয়ে মনমোহনও যোগাযোগ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ শুরু করেন। ২০০৬ সালে তিনি যখন জাপান যান, তখনও শিনজো আবেই সে দেশের প্রধানমন্ত্রী। |
বিশেষ বিমানে প্রধানমন্ত্রী। টোকিওয় নামার আগে। সোমবার। ছবি: পি টি আই |
এ বারেও সেই আবের সঙ্গেই বৈঠক করবেন মনমোহন। এবং এই সফরে আলোচনায় অর্থনীতি প্রসঙ্গ থাকলেও অনেক বেশি গুরুত্ব পেতে চলেছে নিরাপত্তার বিষয়টি। ক’দিন আগেই চিনের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত বিবাদ আবার মাথাচাড়া দিয়েছিল। চিনের প্রধানমন্ত্রী লি খ্যছিয়াংয়ের সফরের পর সেই উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হয়। কিন্তু নিজেদের চিনা নীতিতে কোনও পরিবর্তন করেনি ভারত। আবার চিন ও উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে দু’টি দ্বীপ নিয়ে জাপানের বিবাদ চলছেই। উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র গবেষণা এবং পরের পর হুমকিতেও নিরাপত্তার অভাব বোধ করছে জাপান। এই পরিস্থিতিতে ভারতের সঙ্গে তারা সম্পর্ক জোরদার করতে চাইবে বলেই কূটনৈতিক মহলের একটি অংশের বিশ্বাস। আবার ভারতও চিনকে জানিয়ে দিয়েছে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, মায়ানমার, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলির সঙ্গে তারা সুসম্পর্ক রেখে চলবে। একমাত্র এই ভাবেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারসাম্য রাখা সম্ভব।
জাপানের মানুষ যুদ্ধ আর হিংসায় ক্লান্ত। দিল্লির জহওরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের জাপানিজ স্টাডিজের অধ্যাপক শ্রাবণী রায়চৌধুরী বলেন, “প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেন, ফ্রান্স আর রাশিয়ার পাশে ছিল জাপান। তখন জার্মানির সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে চিনের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণা করে তারা।” দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আবার আমেরিকার পার্ল হারবারে আক্রমণ করে জাপানি বোমারু বিমান। এর পাঁচ বছর পরে, ১৯৪৫ সালের অগস্টে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা ফেলে আমেরিকা। ওই ঘটনায় বহু লক্ষ মানুষ হতাহত হন। তার পরেই জাপান যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। এবং প্রতিরক্ষা বাজেট শূন্য করে দেয়।
কিন্তু এখন গোটা বিশ্বের পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে তাতে জাপানকে এখন নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু করতে হয়েছে। ২০০০ সাল থেকে জাপানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক প্রত্যক্ষ ভাবে না হলেও প্রতিরক্ষা খাতে কিছু আর্থিক সহায়তা দেওয়া শুরু করেছে। ২০১১ সাল থেকে ভারতের সঙ্গে যৌথ ভাবেও নৌ-সেনা মহড়াও শুরু করেছে জাপান।
হিরোশিমা-নাগাসাকির পরেও অর্থনীতিতে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে জাপান। কিন্তু সাম্প্রতিক পশ্চিমের আর্থিক মন্দা আর চিনা ড্রাগনের নিঃশ্বাস জাপানের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। এই পটভূমিতে শিনজো আবে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে তাঁর দক্ষিণপন্থী দল উদার লিবারাল ডেমোক্রেটিক পার্টি আক্রমণাত্মক সংস্কারের পথে হাঁটছে। ১৯৯১ সালে বলা হতো মনমোহনমিক্স। জাপানের সংসদে ৪৮০ আসনের ২৯৪টি দখল করে এখন জাপানে জনপ্রিয় হয়েছে আবেনমিক্স।
কী করছেন আবে?
তিনি সরকারের খরচ বাড়িয়েছেন প্রায় ১০ হাজার কোটি ডলার। এর ফলে মূল্যবৃদ্ধি ২ শতাংশ হারে বাড়বে বলে জানিয়েছে জাপান ব্যাঙ্ক। কিন্তু তাতেও সরকারি খাতে খরচ বাড়াতে পিছপা নন আবে। জাতীয়তাবাদী জাপান এ বার প্রতিরক্ষা খাতেও অর্থ বরাদ্দ করার কথা ভাবছে। ইতিমধ্যেই আবের অর্থনীতির দাওয়াইয়ের কারণে জাপানের শেয়ার বাজার ৫৫ শতাংশ বেড়েছে। বাজার তেজি। ইতিমধ্যেই টয়োটা ও সোনির মতো সংস্থাগুলি তাদের লাভ ঘোষণা করেছে। এই পরিস্থিতিতে জাপান পুরানো নীতি ছেড়ে রফতানি বাড়াতে চাইছে। ভারতে জাপানি লগ্নি বাড়ার সুযোগ আসছে। মনমোহন সিংহ বা তাঁর অর্থমন্ত্রী ও আর্থিক উপদেষ্টারা সেই সুযোগ হারাতে চাইছেন না।
জাপানে তিন দিন থাকছেন মনমোহন। সব দলের প্রতিনিধির সঙ্গেই তাঁর বৈঠক হওয়ার কথা। জাপানের সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের প্রতিভূ সম্রাট আকিহিতোর সঙ্গেও তাঁর বৈঠক নির্ধারিত রয়েছে। মনমোহন জানেন, জাপানের মানুষ বড় বেশি দেশাভিমানী। সততা ও আত্মমর্যাদার অহঙ্কার রয়েছে তাদের রক্তে। চিন ও উত্তর কোরিয়া বারংবার দাবি জানালেও জাপান কিন্তু অতীতের যুদ্ধের জন্য এখনও তাদের কাছে ক্ষমা চায়নি। এ দেশে দোকানি খুচরো ঠিক দিয়েছে কি না, তা কেউ গুনে দেখে না। সেটা শিষ্টাচার নয়। জাপানের মানুষ বন্ধুত্ব পাততে সময় নেয়। কিন্তু একবার বন্ধুত্ব হয়ে গেলে তা খুব সহজে নষ্ট করতেও চায় না। মনমোহন এই বন্ধুত্বের অঙ্গীকারটি করতেই এসেছেন সূর্যোদয়ের দেশে। |