সাইকেলের সামনে অসুস্থ ছেলেকে বসিয়ে মা চলেছেন মাধ্যমিক পরীক্ষাকেন্দ্রে। গ্রামবাসীরা এই দৃশ্য দেখেছেন নিয়মিত। এখন হাওড়ার আমতায় নওপাড়া গ্রামে মা পূর্ণিমা আশের ঘরে খুশির হাওয়া। ছেলে দিব্যেন্দু মাধ্যমিকে পাশ করেছে।
মা ও ছেলের লড়াই বড় কঠিন ছিল। পূর্ণিমার স্বামী চাঁদুরামের ছোট কারখানা ছিল হাওড়ার ইছাপুরে। বছর চারেক আগে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। তখন দিব্যেন্দু স্থানীয় নওপাড়া হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। তার দিদি পিঙ্কি পড়ত অষ্টম শ্রেণীতে। দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে পূর্ণিমাদেবী পড়েন অথৈ জলে।
ওই সময়েই মেয়ে পিঙ্কির হৃদ্যন্ত্রে দেখা দেয় বড়সড় ত্রুটি। দ্রুত অস্ত্রোপচার না হলে প্রাণসংশয় হতে পারে, বলেন ডাক্তারেরা। অসহায় পূর্ণিমাকে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা অস্ত্রোপচারের খরচ দিতে রাজি হয়। স্বামীর কারখানা বেচে পূর্ণিমা জোগাড় করেন বাকি টাকা। দুর্গাপুরে মিশন হাসপাতালে পিঙ্কির অস্ত্রোপচার হয়। সে এখন দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ছে। |
মায়ের সঙ্গে দিব্যেন্দু। —নিজস্ব চিত্র। |
কিন্তু এ বার ছেলে দিব্যেন্দুর হৃদ্যন্ত্রে গুরুতর ত্রুটি ধরা পড়ে। এ বারেও ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাই অস্ত্রোপচারের টাকা দিতে রাজি হয়। বিক্রি করার মতো আর কিছু না থাকায় পূর্ণিমা বাকি খরচ জোগাড় করেন চেয়ে-চিন্তে। গত বছর ১৮ জুলাই দিব্যেন্দুর অস্ত্রোপচার হয় দুর্গাপুরের একই হাসপাতালে।
অস্ত্রোপচারের পরে প্রায় আট মাস দিব্যেন্দু স্কুলে যেতে পারেনি। বাড়িতে পড়েই টেস্ট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। কিন্তু মাধ্যমিক পরীক্ষার দিন কুড়ি আগে অস্ত্রোপচারের জায়গায় সংক্রমণ হয়। একই হাসপাতালে ফের অস্ত্রোপচার হয় তার। এই অবস্থায় মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে চায়নি দিব্যেন্দু। কিন্তু তার মায়ের জেদ, বসতেই হবে পরীক্ষায়। পরীক্ষা কেন্দ্র ছিল প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে, আমতা বালিকা বিদ্যালয়ে। গাড়ি ভাড়া করার পয়সা ছিল না পূর্ণিমার কাছে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন নিজেই সাইকেলে চাপিয়ে ছেলেকে নিয়ে যাবেন পরীক্ষা কেন্দ্রে। পূর্ণিমার কথায়, “প্রতিদিন বাড়ি থেকে পরীক্ষাকেন্দ্র পর্যন্ত সাইকেলে যেতে সময় লাগত ৪৫ মিনিট। আসতেও লাগত একই সময়। পরীক্ষার সময়টুকু স্কুলের বাইরে ঠায় বসে থাকতাম।”
দিব্যেন্দু বলে, “মায়ের জেদ ও ইচ্ছা দেখেই পরীক্ষায় বসতে রাজি হই আমি।” হৃদযন্ত্রের সমস্যার জেরে একটি চোখের দৃষ্টিও হারিয়েছে দিব্যেন্দু। প্রধান শিক্ষক দেবাশিস ধাওয়া বলেন, “যে প্রতিকূলতার মধ্যে ও পরীক্ষা দিয়েছে তা অবিশ্বাস্য। ওর চিকিৎসার জন্য আমরা চাঁদা তুলে কিছু অর্থ সাহায্যও করেছি।”
পূর্ণিমা ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু অর্থ সাহায্য পান। নিজে ছোটখাটো সংস্থায় চাকরি করে মাঝে মাঝে অনিয়মিত রোজগার করেন। কিন্তু ছেলেমেয়েদের পড়ানোর জেদ ছাড়তে নারাজ তিনি। তাঁর কথায়, “অষ্টম শ্রেণির পরে আমার বিয়ে হয়ে যায়। অন্তত মাধ্যমিক পাশ করলে পঞ্চায়েতে একটা চাকরি পেতে পারতাম। শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আমি বুঝি। তাই ছেলেকে জোর করেই পরীক্ষায় বসিয়েছিলাম।” দিব্যেন্দু মাধ্যমিকে পেয়েছে ২৭৩।
চিকিৎসক সত্যজিৎ বসু দিব্যেন্দুর অস্ত্রোপচার করেছেন। তাঁর কথায়, “দিব্যেন্দু যে ভাবে পরীক্ষা দিয়েছে এবং উত্তীর্ণ হয়েছে তার মূল্য আলাদা। তাকে কোনও নম্বর দিয়ে বিচার করা যাবে না।” |