কংগ্রেসের সঙ্গে জোট না থাকলেও ভোটের ফলে তাঁদের কোনও ক্ষতি হবে না বলে দাবি করেছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। হাওড়া লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে প্রচারে নেমেই তিনি কংগ্রেসকে আক্রমণের নিশানা করেছেন। ২৪ ঘণ্টা আগেই হাওড়ার বালিতে প্রচারে গিয়ে তিনি কংগ্রেসকে ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করার চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। সেই আক্রমণের রেশ টেনে মঙ্গলবার দ্বিতীয় দফায় প্রচারে গিয়ে পাঁচলার রানিহাটিতে মমতা বলেছেন, “কংগ্রেসের সঙ্গে জোট না থাকলে ফল খারাপ হবে, এই তত্ত্ব ভুল।”
কংগ্রেসকে ‘স্বার্থপর দৈত্য’র সঙ্গে তুলনা করে তাদের সঙ্গে জোট না থাকলে আখেরে যে তৃণমূলের লাভ তা প্রচার সভায় বোঝানোর চেষ্টাও করেছেন মমতা। তিনি বলেছেন, ২০১০ সালে কলকাতা পুরসভার ভোটে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট না থাকা সত্ত্বেও তৃণমূলের ফল ভাল হয়েছিল। ১৪১টা আসনের মধ্যে তৃণমূল একাই ১০০টা আসনে জয়ী হয়েছিল। তার পরবর্তী সময়ে জোট না করেই রাজ্যের ৮২টি পুরসভার ভোটে তৃণমূল ৬৫টি দখল করেছিল। আসলে সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে, জোট না করলে লোকসভায় তৃণমূলের আসন কমবে। |
আন্দুলের জনসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র। |
সেই প্রেক্ষিতে জোট করা নিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের একাংশ এখনও দোলাচলে রয়েছে। দলের সেই অংশের কাছেই মমতা বার্তা দিয়েছেন, জোট করলেই তৃণমূল লাভবান হবে এমন ভাবার কোনও কারণ নেই।
হাওড়ায় কংগ্রেস তাঁদের প্রতিপক্ষ থাকায় এবং বামবিরোধী ভোট ভাগাভাগির প্রশ্নে গতবারের তুলনায় তৃণমূলের জয়ের ব্যবধান কমলে আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটে তার প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে শাসক দলের নেতাদের অনেকেরই। মমতা নিজেও সেই বিষয়ে ওয়াকিবহাল। সেই কারণে, বালির সভার মতো এ দিন দ্বিতীয় দফার প্রচারের এসেও মমতা ওই প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। তিনি বলেছেন যে, তৃণমূলকে হারাতে কংগ্রেস, সিপিএম এবং বিজেপি-র ‘অনৈতিক জোট’ হয়েছে। তৃণমূলের ভোট কমলে বা হারলে পঞ্চায়েত নির্বাচনে তার প্রভাব পড়বে বলে বিরোধীরা ভাবছে বলে মমতা বলেছেন। আর সেই কারণেই তিনি যে সিপিএম, বিজেপি তো বটেই, কংগ্রেসেকেও তাঁর আক্রমণের নিশানা করেছেন তা এ দিন রানিহাটি ও আন্দুলের সভাতেও স্পষ্ট হয়েছে। |
বলতে বলতে। মঙ্গলবার হাওড়ার রানিহাটিতে উপনির্বাচনী প্রচারে। ছবি: সুমন বল্লভ। |
আন্দুলের সভায় তিনি অভিযোগ করেন, “কেন্দ্র এ রাজ্যে সমান্তরাল প্রশাসন চালাচ্ছে।” বালির নির্বাচনী সভায় মমতা বলেছিলেন, “বাঘের বাচ্চা হলে ৩৬৫ জারি করো, বুঝে নেব।” এ দিন রানিহাটিতেও তৃণমূল নেত্রী আবার বলেন, “আমি তো কংগ্রেসকে চ্যালেঞ্জ করেছি, ক্ষমতা থাকলে সরকার ভেঙে দাও, আমি বুঝে নেব।”
কংগ্রেসের সঙ্গে তিনি যে জোটের দরজা আপাতত বন্ধই রাখবেন তার ইঙ্গিতও এ দিন হাওড়ার দু’টি সভাতেই তৃণমূল নেত্রী দিয়েছেন। রানিহাটি ও আন্দুলের দু’জায়গাতেই তিনি বলেছেন, “ইউপিএ-২ হয়েছে। কিন্তু ইউপিএ তিন হবে না।’’ দিল্লির কংগ্রেসের উদ্দেশে তাঁর হুঁশিয়ারি, “বাংলাকে অহঙ্কার দেখাবেন না, দম্ভ দেখাবেন না।” তৃণমূল নেতাদের একাংশের ব্যাখ্যায়, সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্ত সহ বিভিন্ন বিষয়ে রাজ্যের সঙ্গে দিল্লির সরকারের সংঘাতের বাতাবরণে কংগ্রেসকে চাপে রাখতেই মমতা ‘আক্রমণই রক্ষণের সেরা উপায়’ বলে বেছে নিয়েছেন। |
আন্দুলে লোকসভার উপনির্বাচনের প্রচারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সঙ্গে দলের প্রার্থী প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়।
মঙ্গলবার ছবিটি তুলেছেন সুব্রত জানা। |
রানিহাটি ও আন্দুলে এ দিন সভা করতে গিয়ে মমতা রাজ্যে লগ্নি সংস্থার বেআইনি কারবার নিয়ে বিস্তারিত বক্তব্য রাখেন। লগ্নি সংস্থার বেআইনি কারবারের রমরমা নিয়ে সোমবার বালির প্রচার সভায় মুখ্যমন্ত্রী সিপিএমকেই দায়ী করেছিল। এ দিন রানিহাটি বা আন্দুলের সভায় বিস্তারিত ভাবে বিষয়টি নিয়ে বলেন তৃণমূল নেত্রী। সারদা গোষ্ঠীর নাম করে তিনি সিপিএমের সরকারকে কটাক্ষও করেন। তিনি বলেন, “সারদা কার সময়ে হয়েছে? সিপিএমের সময়ে। ১৯৯৫ সালে। তৃণমূলের সরকার তো এসেছে ২০১১ সালে।” তারপরেই তিনি শ্রোতোদের উদ্দেশে প্রশ্ন ছোড়েন, “এটা সত্যি, না মিথ্যা?” শ্রোতারা বলেন, “সত্যি।” তারপরেই মমতার তির্যক মন্তব্য, “কমরেড ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে চোখে পদ্মফুল দেখছিলেন বুঝি!” এরপরেই মুখ্যমন্ত্রী জানান, লগ্নি সংস্থার কারবারে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে অর্থ ফেরত দিতেই তাঁর সরকার কমিশন বসিয়েছে। তিনি বলেন, “বিলটি রাষ্ট্রপতির সই হয়ে আসার পরেই যারা মানুষকে প্রতারিত করেছে তাদের সম্পত্তি, জমি বিক্রি করে যতটা সম্ভব টাকা ফেরতের ব্যবস্থা হবে।” এ দিনের সভায় লগ্নি সংস্থার বেআইনি কারবার নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এতখানি সরব হওয়া নিয়ে তৃণমূলের অন্দরের খবর, সারদা-কাণ্ডে শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দারই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সে দিকে লক্ষ্য রেখেই মমতা বিষয়টি নিয়ে তাঁর এক ঘণ্টার বক্তৃতায় প্রায় ১০ মিনিট
ব্যয় করেছেন।
বালির তুলনায় রানিহাটি ও আন্দুল দু’টি সভাতেই এ দিন উপচে পড়া ভিড় ছিল। বালির সভায় কেন ভিড় কম হল তা নিয়ে সোমবার রাতে মমতা-সহ তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব খোঁজ নেন। দলীয় সূত্রে খবর, দলের জেলা সভাপতি অরূপ রায় ও বালির বিধায়ক সুলতান সিংহের সঙ্গে সমন্বয়ের অভাবেই বালির সভায় জনসমাগম আশানুরূপ হয়নি বলে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব ওইদিন রাতেই জানতে পারেন। সঙ্গে সঙ্গেই তৃণমূলে নেত্রীর নির্দেশে বিষয়টি নিয়ে রাজ্যের মন্ত্রী ও হাওড়ার ভোটের প্রচারের দায়িত্বে থাকা রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় স্থানীয় নেতাদের নিয়ে আলোচনা করেন। ভোটের কাজে এ ধরনের সমন্বয়ের অভাব এবং ভোট বাক্সে কোনও প্রভাব যাতে না পড়ে তার জন্য জেলা নেতাদের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
|
(তথ্য সহায়তা: অভিষেক চট্টোপাধ্যায়) |