প্রবন্ধ ২...
সব কিছু উপর থেকে ঠিক করা হবে কেন
দারিদ্রের পরিমাপ নিয়ে আমরা আগের লেখায় আলোচনা করেছি। এ বার নীতির প্রশ্ন। কী ভাবে দারিদ্র কমানো যায়? আয়বৃদ্ধির সঙ্গে দারিদ্রের সম্পর্ক কী? প্রথমেই বলা দরকার, আয় এবং ব্যয়ের বিন্যাস সাধারণত এ রকম হয়ে থাকে যে, দারিদ্ররেখা যে ভাবেই নির্ধারণ করা হোক না কেন, তার নীচে এবং কাছাকাছি তুলনায় অনেক বেশি লোক থাকে। ফলে আয়বৃদ্ধির গতি বাড়লে দারিদ্র দূর করার প্রক্রিয়ায় প্রথমে তুলনায় ভাল ফল পাওয়া যায় দারিদ্রের অনুপাত অনেকটা কমে যায়, কারণ যাঁরা দারিদ্ররেখার নীচে ছিলেন তাঁরা চট করে সেই রেখার উপরে চলে আসতে পারেন। ভারতে, বিশেষ করে পঞ্জাব, হরিয়ানা, কেরল, তামিলনাড়ু, গুজরাত, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং অসমের মতো রাজ্যে এটা দেখা গিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, গরিব মানুষ নিশ্চয়ই গরিব থাকতে চান না, তাঁরা গরিব থাকেন বিভিন্ন জিনিসের অভাববশত। যেমন, শিক্ষা ও দক্ষতা, স্বাস্থ্য পরিষেবা, বাজারের খোঁজখবর, প্রযুক্তি, আর্থিক সম্পদ ও সুযোগ, রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, জল, নিকাশি ব্যবস্থা ইত্যাদি। সুতরাং দারিদ্রের মোকাবিলার জন্য এই জিনিসগুলি যথাযথ ভাবে সরবরাহ করা জরুরি। সাড়ে ছয় দশক ধরে বিপুল সরকারি ব্যয় সত্ত্বেও এই জরুরি পণ্য ও পরিষেবাগুলি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়নি বলেই এখনও দারিদ্র প্রবল। পাশাপাশি, বহু মানুষ এখনও কোনও ক্রমে খিদে মেটানোর উপযোগী চাষবাসেই আটকে আছেন, কারণ তাঁদের বিকল্প কোনও ভাল কাজের সুযোগ নেই। তাঁরা গরিব, কারণ পঁয়ষট্টি বছরেও আমরা কৃষি এবং গ্রামীণ অর্থনীতির সংস্কার আনতে পারিনি।
তথ্যের খোঁজে রাষ্ট্র। জনগণনার কাজ, লালগড়, ২০১০। ছবি: অমিত দত্ত
তৃতীয়ত, আমরা দারিদ্রকে যে ভাবে দেখি, তাতে একটা মস্ত ভুল হয়। যে কোনও দারিদ্রের পরিসংখ্যানে কিছু বিশেষ বর্গের স্বতন্ত্র হিসেব থাকে: তফসিলি জাতি ও জনজাতি (এস সি ও এস টি), অন্যান্য অনগ্রসর জাতি (ও বি সি) এবং মুসলিম। প্রশ্ন হল, এই বর্গের দরিদ্ররা কি এই বর্গের মানুষ বলে দরিদ্র, না উপরোক্ত পণ্য ও পরিষেবাগুলি তাঁদের হাতে পৌঁছয় না বলে তাঁরা দরিদ্র? দারিদ্র একটি ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সমস্যা, তাকে বিভিন্ন বর্গের সমষ্টিগত সমস্যা হিসেবে দেখলে ভুল হয়। আমরা তখন ব্যক্তি বা পরিবারের বিশেষ অবস্থা বা সমস্যা বা অভাবগুলিকে ঠিক ভাবে দেখি না, তাঁদের কেবল একটা সমষ্টির অঙ্গ হিসেবে দেখি। অথচ এই বর্গগুলির সবাই যে গরিব, তা নয়। আবার, এই বর্গগুলির বাইরে যাঁরা আছেন, তাঁরাও কেউ গরিব নন, এমন নয়। এই বাস্তবটা সমষ্টি-দর্শনে হারিয়ে যায়।
চতুর্থত, দরিদ্রের কাছে উপরোক্ত পণ্য ও পরিষেবাগুলি ঠিক ঠিক পৌঁছনোর কাজটা অচিরে হওয়ার নয়। গ্রামীণ অর্থনীতির সংস্কারও সময়সাপেক্ষ। সুতরাং আপাতত দরিদ্রের জন্য ভর্তুকির ব্যবস্থা চলছে, চলবে। সেই ভর্তুকি কী ভাবে দেওয়া হবে, তা নিয়ে আমাদের পরীক্ষানিরীক্ষার অন্ত নেই। এখন যেমন ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন অথরিটি (ইউ আই ডি) মারফত আধার কার্ড দিয়ে দুনিয়ার সমস্ত সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে। সংসদে প্রয়োজনীয় আইন পাশ না করিয়ে, প্রয়োজনীয় রক্ষাকবচের ব্যবস্থা না করেই আমরা আধার প্রকল্পে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। পাশাপাশি, খাদ্য, সার, পেট্রোলিয়মজাত পণ্য ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে ভর্তুকির যে বন্দোবস্ত চালু আছে, তার বদলে এই সব ক্ষেত্রে সরাসরি নগদ হস্তান্তরের পদ্ধতি চালু করার উদ্যোগ চলছে।
ভর্তুকি সরাসরি নগদে দেওয়ার নীতি যে নীতি হিসেবে শ্রেয়, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এই পদ্ধতিতে সম্পদের বণ্টনে কোনও বিকৃতি ঘটে না। দরিদ্র মানুষ এই ব্যবস্থায় নিজের প্রয়োজন বা পছন্দ অনুসারে ভর্তুকির টাকা খরচ করার সুযোগ পান। যাঁরা মনে করেন, গরিব মানুষের হাতে টাকা তুলে দিলে সে টাকা বাজে খরচ হবে, তাঁদের ধারণা ভুল এবং অন্যায়। ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার সর্বজনীন অধিকার, দারিদ্ররেখা দিয়ে সেই অধিকারের গণ্ডি টানা যায় না। কিন্তু দারিদ্ররেখার নীচে কে আছেন, কে নেই, সেটা চিহ্নিত করতে হবে, প্রযুক্তি সেই কাজটা করে দিতে পারবে না। যতক্ষণ না বি পি এল চিহ্নিত করার এই কাজটা সুসম্পন্ন হচ্ছে, আমরা ঘুরতেই থাকব, সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান করতে পারব না।
এই মৌলিক প্রশ্নগুলির সদুত্তর খোঁজার যথেষ্ট উদ্যোগ না করে যোজনা কমিশন দারিদ্রের পরিসংখ্যান এবং অনুপাত কষেই চলেছে, বিরাম নেই। সংখ্যার এমন মাহাত্ম্য কেন? তার কারণ হল, খাদ্য এবং গ্রামোন্নয়নের নানা খাতে কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন রাজ্যে যে ভর্তুকি বা অনুদান দেয়, তা নির্ধারিত হয় দারিদ্রের অনুপাতের ভিত্তিতেই। সুতরাং যোজনা কমিশন এবং কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক দারিদ্রের হিসেব কষেই চলে। সেই পরিসংখ্যান কতটা নির্ভরযোগ্য, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। জাতীয় নমুনা সমীক্ষার (এন এস এস) পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয় অনেকটা দেরিতে, পাঁচ বছর অন্তর। তা ছাড়া, এন এস এস তো সমস্ত নাগরিকের খোঁজ করে না, নমুনা সমীক্ষা করে, সেই নমুনা সামগ্রিক বাস্তবের সম্পর্কে কতটা যথাযথ খবর দিতে পারে সে বিষয়ে সংশয় থেকেই যায়।
তার পরে ওঠে বিকেন্দ্রীকরণের প্রশ্ন। দারিদ্রের মাত্রা নির্ধারণের কাজটা হওয়া উচিত বিকেন্দ্রীকরণের ভিত্তিতে, পরিবার-ভিত্তিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে। নবম যোজনার (১৯৯৭-২০০২) সময় থেকে এ বিষয়ে কথাবার্তা চলছে, কিন্তু সেই প্রস্তাব ঠিক ভাবে কার্যকর করা হয়নি। আমরা রকমারি মাপকাঠি নিয়ে কাজ চালাচ্ছি এবং এখনও সমস্ত সমীক্ষাই পরিচালিত হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারের বা যোজনা কমিশনের তৈরি কাঠামো অনুসারে। কেন্দ্র থেকে রাজ্যের হাতে ক্ষমতা তুলে দিলে এবং রাজ্যের মধ্যেও বিকেন্দ্রীকরণ প্রসারিত হলে বি পি এল নির্ধারণের দায়িত্ব ও অধিকার কেন গ্রামসভা বা অনুরূপ কোনও স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়া হবে না? এই বিকেন্দ্রীকরণ কেবল অর্থনীতির যুক্তিতেই শ্রেয় নয়, ভর্তুকির গোটা ব্যবস্থাটাই এর ফলে অনেক উন্নত হতে পারে।

দিল্লিতে সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এ অর্থনীতিবিদ


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.