অসুখ মানেই ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গি নয়। নানান অসংক্রামক
অসুখও কোনও অংশে কম যায় না। লিখছেন
মানবেশ সরকার ও পিয়া সেন |
গ্রীষ্ম আসে, তার পর বর্ষা, আর আমরা ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি, এবং তাদের সঙ্গীসাথিদের জন্য মনে মনে প্রস্তুত হই। অসুখ নিয়ে খবর মানেই সংক্রামক ব্যাধির খবর। অথচ, সংক্রামক নয়, এমন নানান অসুখের নীরব আক্রমণও কোনও অংশে কম যায় না। ভারতে ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সের লোকের রোগের ৬২ শতাংশই দীর্ঘস্থায়ী বা অসংক্রামক রোগের জন্য, ২০০৪ সালে ভারতে মোট মৃত্যুর ৩৫ শতাংশই ছিল দীর্ঘস্থায়ী বা অসংক্রামক রোগের কারণে। অসংক্রামক রোগগুলির অন্যতম করোনারি হার্টের রোগে ২০০৫ সালে সারা ভারতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩ কোটির উপরে, আশঙ্কা ২০১৫-য় তা দ্বিগুণ হবে। পশ্চিমবঙ্গের ছবিটাও ভীতিপ্রদ। প্রতীচী ইনস্টিটিউটের একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, রাজ্যে উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ, গাঁটের ব্যথা এবং শ্বাসকষ্টের মতো সাতটি অসংক্রামক রোগে ভুগছিলেন মোট রোগাক্রান্তের ৫২ শতাংশ (গত বছর মার্চ মাসের হিসেব)। সমীক্ষা অনুযায়ী অসংক্রামক রোগগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে অস্থিজনিত রোগ, তার পরেই রক্তচাপ ও হৃদরোগ। লক্ষণীয়, রক্তচাপ ও হৃদরোগের মতো অসুখ শহরের সম্পন্ন মানুষের মধ্যে বেশি দেখা গেলেও গ্রামে বা তুলনায় অসচ্ছল বর্গের মধ্যেও তা অগ্রাহ্য করার মতো নয়। গাঁটের ব্যথা বা শ্বাসের রোগ তো আবার গ্রামেই বেশি। অনেক অসংক্রামক রোগই বয়স্কদের সঙ্গে সঙ্গে তুলনায় কমবয়সিদের মধ্যেও রীতিমত প্রবল। |
জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে (২০০২) অসংক্রামক রোগের বাড়বাড়ন্তের স্বীকৃতি থাকলেও তার জন্য কোনও নির্দিষ্ট কর্মসূচি ছিল না। পশ্চিমবঙ্গেও সরকারি স্তরে অসংক্রামক রোগের ব্যাপ্তিকে বোঝার খুব বেশি প্রচেষ্টা হয়েছে বলে জানা যায় না। বেশ কয়েকটি প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্র ঘুরে বোঝা গেছে, না আছে অসংক্রামক ব্যাধির পরীক্ষানিরীক্ষার ব্যবস্থা, না আছে ওষুধ, না আছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। উত্তরবঙ্গের একটি ব্লক প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্রে গিয়ে শোনা গেল যে, দু’জন ল্যাব-টেকনিশিয়ান আছেন, কিন্তু ম্যালেরিয়া ছাড়া অন্য কোনও রক্ত পরীক্ষাই সেখানে হয় না। সমীক্ষা অনুসারে, ৩২ শতাংশ রোগী সরকারি ব্যবস্থার উপর নির্ভর করেন, ‘হাতুড়ে’ এবং ওষুধের দোকান থেকে চিকিৎসা নেওয়া রোগীর অনুপাত ২৫ শতাংশ! আদিবাসী ও মুসলমানদের ক্ষেত্রে এটা অনেক বেশি।
প্রশ্ন উঠতে পারে, ৩২ শতাংশই বা সরকারি ব্যবস্থায় যান কেন? একটা কারণ অবশ্যই আর্থিক অসামর্থ্য। কিন্তু আর একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণও আছে: বেশ কিছু জায়গায় আমরা দেখেছি সরকারি ব্যবস্থায় নিষ্ঠাবান স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসকরা নানা বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও যে নিষ্ঠা দেখাচ্ছেন, তা অনুকরণযোগ্য। খারাপ নির্দশনগুলোর বিপরীতে এগুলোই প্রাণবায়ু। তবে অসংক্রামক রোগীদের খুব কম অংশই মহকুমা হাসপাতালের নীচের স্তরে ভর্তি হন। অসংক্রামক রোগের চিকিৎসার জন্য বুনিয়াদি স্তরের সরকারি চিকিৎসালয়ের অকর্মণ্যতা ভারতের সব রাজ্যের জন্যই কমবেশি সত্য। উল্লেখ্য, বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েও (তুলনায় সচ্ছল মানুষরাই যেখানে যান বেশি) যে মানুষ বিশেষ পরিতৃপ্ত, এমনও নয়।
এক দিকে যেমন অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধী পরিকাঠামো, পরিষেবা ও শিক্ষা কোনওটাই প্রায় নেই, তেমনই উল্টো দিকে বেড়ে চলেছে চিকিৎসার ব্যয়। জাতীয় নমুনা সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, ১৯৯৫-৯৬-এ ভারতে অসংক্রামক রোগের জন্য মানুষের চিকিৎসার খরচ যেখানে ছিল মোট চিকিৎসার খরচের ৩২ শতাংশ, ২০০৪-এ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৭ শতাংশ। বেসরকারি ক্ষেত্রে খরচ আরও বেশি, কিন্তু সরকারি হাসপাতালেও বহু ক্ষেত্রেই পরীক্ষানিরীক্ষা ও ওষুধের খরচটা রোগীকেই বহন করতে হয়।
সব মিলিয়ে ছবিটা উদ্বেগজনক। প্রতিকারের জন্য সরকারের অবিলম্বে তৎপর হওয়া দরকার।
|
প্রতীচী ইনস্টিটিউটে কর্মরত |