ঠিক ষাট বছর আগে এই দিনে পৃথিবীর চূড়ায় হাজির হলেন দুই তরুণ। অমনি সবাই জানতে
চাইল, কে আগে? চাইবেই। রাজনীতি অতি বিষম বস্তু। আর, মাউন্ট এভারেস্টকে
নিয়ে জাতীয়তার দড়ি টানাটানি তো শুরু হয়েছে সেই শুরু থেকেই।
গৌতম চক্রবর্তী |
বেলা সাড়ে এগারোটায় শীর্ষভূমিতে পা রাখলেন এডমন্ড হিলারি, ৩৪। তাঁর ঠিক পিছনেই তেনজিং নোরগে, ৩৯। দুনিয়ার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্টে এই প্রথম মানুষের পদচিহ্ন। ২৯ মে, ১৯৫৩।
ষাট বছরে পৃথিবী বদলেছে। শিখরজয়ের জন্য সে দিন ২৭,৯০০ ফুট উচ্চতায় ৯ নম্বর শিবির থেকে ভোর সাড়ে ছ’টায় রওনা হয়েছিলেন হিলারি-তেনজিং জুটি। এখন তিন-চারটে শিবিরই যথেষ্ট। দিনে নয়, অ্যাডভান্সড ক্যাম্প থেকে সন্ধ্যায় বেরিয়ে পরদিন সকালে শিখর ছোঁয়াই নিয়ম। তেনজিংদের জয়ের খবর দুনিয়াকে জানাতে নামচেবাজারের পোস্টাপিসে টেলিগ্রাম করতে ছুটেছিল রানার। এখন স্যাটেলাইট ফোনে এভারেস্ট-চুড়ো থেকেই কথা বলা যায়।
কিছু ইতিহাস কিন্তু অটুট। যেমন নেপালের খুম্বু অঞ্চলের হতদরিদ্র শেরপা সম্প্রদায়, যেখান থেকে তেনজিং উঠে এসেছিলেন। তাঁদের ভাষায় লিখিত বর্ণমালা নেই, পাহাড়ে মালপত্র বয়ে আর ইয়াক চরিয়ে জীবন কাটাতে হয়। বিংশ শতাব্দীতে তেনজিং-ই প্রথম এশিয়া থেকে উঠে-আসা নিম্নবর্গের নায়ক। তাঁর আগে কোনও এশীয় বীর এত নিচু স্তর থেকে উঠে আসেননি।
এক বাঙালির সৌজন্যে সেই ‘সাব-অল্টার্ন’ নায়কের হাত ধরেই এভারেস্টে পৌঁছেছিল জাতীয় পতাকা। তেনজিংরা সে দিন চুড়োয় ১৫ মিনিট ছিলেন। সেখানে পৌঁছে তেনজিং বরফে একটা লাল-নীল পেন্সিল পুঁতে দিলেন। দার্জিলিঙের শেরপাবস্তি থেকে রওনা হওয়ার আগে ছোট মেয়ে নিমা তাঁকে পেন্সিলটা দিয়েছিল। তার পর পুঁতলেন আইস-অ্যাক্স-এর হাতলে জড়ানো চারটি পতাকা। রাষ্ট্রপুঞ্জ, ব্রিটেন, নেপাল ও ভারত। তেনজিংয়ের বন্ধু, দার্জিলিঙের ছাপাখানার মালিক রবীন্দ্রনাথ মিত্র শেষেরটি দিয়েছিলেন। রেকর্ড ভাঙা-গড়ার বাজারে সেই ‘রবিবাবু’ আজ হারিয়ে গিয়েছেন। |
বিস্মৃতির অতলে আরও এক বাঙালি। গত শতকের বিশের দশকে তিব্বতের দিক থেকে এভারেস্ট-অভিযান শুরু হয়। কিন্তু অনুমতি নিয়ে তখন হরেক টালবাহানা। ভারত সরকারের আন্ডারসেক্রেটারি লর্ড সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ নিজে উদ্যোগ নিয়ে ১৯২১ সালে ম্যালরি ও অন্য অভিযাত্রীদের অনুমতির বন্দোবস্ত করেন। সেটিই প্রথম এভারেস্ট অভিযান! প্রথম ভারতীয় লর্ডের এই কৃতিত্বটি আমরা খেয়াল রাখিনি।
সল্ট লেকের বাসিন্দা হরপ্রসাদ ভট্টাচার্য সম্প্রতি ‘সম্পাদক সমীপেষু’ বিভাগে চিঠি দিয়ে এ রকমই আর এক বিস্মৃতি খেয়াল করিয়ে দিয়েছেন। সম্প্রতি কলকাতা শহরের কিছু রাস্তার নতুন নামকরণ হল। কিন্তু এভারেস্টের উচ্চতা যিনি পরিমাপ করেছিলেন, সেই বাঙালি রাধানাথ শিকদারের নামে একটিও রাস্তা হল না। এই বছরে তাঁর দ্বিশতজন্মবাষির্কী!
অবহেলার কারণেই আমরা খেয়াল করি না, ভারতে প্রথম যিনি নিউটন ও লাপ্লাস-এর গণিত রপ্ত করেন, তিনি রাধানাথ শিকদার। কোম্পানির আমলে একই সঙ্গে সার্ভে অফিসের চিফ কম্পিউটর এবং আবহাওয়া অফিসের প্রধান তত্ত্বাধায়ক। সেই বিজ্ঞানীকে নিয়ে শুধুই ছেঁদো গল্প। রাধানাথ নাকি ওপরওয়ালা অ্যান্ড্রু ওয়া-র ঘরে ছুটতে ছুটতে এসেছিলেন, ‘স্যর, আমি উচ্চতম শৃঙ্গ আবিষ্কার করেছি।’ ইংরেজরা তবু রাধানাথকে কৃতিত্ব না দিয়ে সার্ভেয়ার জেনারেল জর্জ এভারেস্টের নামে শিখরটির নাম দেয়। এমনিতেই এভারেস্ট তখন অবসর নিয়ে ইংল্যান্ডে। উপরন্তু রাধানাথ কলকাতায়, অ্যান্ড্রু ওয়া দেরাদুনে। রাধানাথ ‘স্যর স্যর’ বলে ওয়ার ঘরে ছুটবেন কী ভাবে?
পরবর্তী কালে জাতীয়তাবাদ এই গল্পটি তৈরি করেছে। জর্জ এভারেস্ট কোনও ভিলেন ছিলেন না, ৭৮ ডিগ্রি দ্রাঘিমারেখা বরাবর উত্তর-দক্ষিণে ২৪০০ কিমি জুড়ে বিস্তৃত যে ‘মেরিডিয়ান আর্ক’, সেটির পরিমাপ তাঁর অন্যতম অবদান। নতুন উপনিবেশকে ভাল ভাবে চেনার স্বার্থে এই সব ভূতাত্ত্বিক পরিমাপ, সত্য। কিন্তু এই রকম ব্যয়বহুল বিজ্ঞানপ্রকল্প সেই প্রথম, এটিও সমান সত্য। ওই কাল্পনিক মেরিডিয়ান আর্কই সটান হিমালয়ে পৌঁছচ্ছে। এভারেস্টের নিয়ম ছিল, শৃঙ্গগুলির স্থানীয় নামই থাকবে। কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে নন্দাদেবী, ত্রিশূল, কামেট আজও সেই নীতি মেনেই স্থানীয় নামেই পরিচিত।
মসুরি থেকে ল্যান্ডোর-এর রাস্তার উল্টো দিকে আজও আছে এভারেস্টের বাসগৃহ ‘পার্ক এস্টেট’। ভাঙাচোরা বাড়িতে অ্যান্টিক ফায়ারপ্লেস এবং কাঠের বিমগুলি অটুট। নেটিভ সার্ভে-কর্মীদের বাড়ির বাগানে কুটির তৈরির অনুমতি দিয়েছিলেন এভারেস্ট। নিয়ম করেছিলেন, নিচু স্তরের কর্মীদের ‘কুলি’ বলা যাবে না, খালাসি বলতে হবে। নিয়মটি আজও বলবৎ।
এ-হেন এভারেস্টের অবসরের পর সার্ভে দফতরের প্রধান হলেন অ্যান্ড্রু ওয়া। তিনি খেয়াল করেন, সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার পিছনে ‘পিক ১৫’ নামে আর একটি শিখর। বিভিন্ন জায়গা থেকে পরিমাপ নেওয়া হল। ওয়া-র সন্দেহ জাগল, এটি কাঞ্চনজঙ্ঘার চেয়েও উঁচু নয় তো? আরও পরিমাপ নেওয়া হল। এবং সন্দেহ নিরসনের ভার দেওয়া হল সেরা গণিতজ্ঞ, কলকাতা অফিসের বাবু রাধানাথ শিকদারের ওপর। ১৮৫২ সালে রাধানাথ দেখালেন, ওই শৃঙ্গটিই সবচেয়ে উঁচু, ২৯০০২ ফুট।
শৃঙ্গের নাম তা হলে কী হবে? কোম্পানির জরিপ বিভাগকে নেপাল, তিব্বত, কেউই নিজেদের মাটিতে ঢুকতে দেয়নি। ফলে স্থানীয় নাম জানার উপায় নেই। তাই ওয়া-র পরামর্শ, শিখরের নাম হোক তাঁর প্রাক্তন ‘বস’ এভারেস্টের নামে। রাধানাথকে বঞ্চিত করার গল্প নেই, উল্টে ওয়া পরে হাউস অব কমন্স-এ রিপোর্ট দেন, ‘বাবু রাধানাথ শিকদারের গাণিতিক জ্ঞান অনেককে ছাপিয়ে যায়।’ লন্ডনে বসে অবসরপ্রাপ্ত এভারেস্ট অবশ্য মজা করে বলেছিলেন, ‘আমার নামে শিখর? কিন্তু নেটিভরা তো ‘ইভরেস্ট’ পদবিটা ঠিকঠাক বলতে পারে না।’
জাতীয়তাবাদী রাজনীতি থেকে সর্বোচ্চ শিখরের আজও মুক্তি নেই। বছর ছয়েক আগে চিনের ‘পিপল্স ডেলি’র সম্পাদকীয়: ‘এভারেস্ট নামটি ঔপনিবেশিক। স্বশাসিত তিব্বত অঞ্চলে শিখরটি তারও আগে থেকে ‘চোমোলাংমা’ নামে পরিচিত।’ নেপালই বা তাদের ‘সাগরমাথা’ নামটি ছেড়ে দেবে কোন দুঃখে?
নামটা আজ পরিচিত। কারণ, নেপালের খুম্বু গ্লেসিয়ার, সাউথ কল দিয়েই বেশি লোক এভারেস্টে ওঠে। গত সপ্তাহেও সব রেকর্ডধারী শিখরে পৌঁছেছেন ওই পথে। উল্টো দিকে, তিব্বতি ঝঞ্ঝাট এড়াতে ‘নর্থ কল’-এর রাস্তা মাঝে মাঝেই বন্ধ রাখে চিন। অথচ, প্রথম অভিযান ছিল ওই রাস্তাতেই। তেনজিং সপ্তম বার সফল হন, তাঁর প্রথম চারটি চেষ্টাই ছিল চিনের দিক থেকে। পরে পঞ্চাশের দশকে তিব্বত দখলের সময় চিন রাস্তা বন্ধ করে দেয়, তখনই নেপাল দিয়ে অভিযান শুরু। এশীয় রাজনীতিই ষাট বছর আগে এভারেস্টে চ
আত্মজীবনীতে তেনজিং জানিয়েছেন, সে দিন একটিই জিনিস তাঁকে দেননি নেহরু। কাবার্ডে-থাকা গাঁধী টুপিটি। সেটি তেনজিংকে দেখিয়ে নেহরু বলেছিলেন, “এটা দেব না। এভারেস্ট বরং রাজনীতির বাইরেই থাকুক।” |