কলিকাতার প্রাণকেন্দ্রে রাজপথ আটকাইয়া মিছিল, সভা-সমাবেশ ইত্যাদি করা চলিবে না, নগরপাল জানাইলেন। আরও জানাইয়াছেন, কলিকাতা পুলিশ এলাকায় আইন অমান্য আন্দোলনও নিষিদ্ধ হইল। সিদ্ধান্তটি স্বাগত। তবে, সভা-সমাবেশ কেন শুধু কেন্দ্রে নিষিদ্ধ হইল, প্রান্তেও নহে কেন? কোনও সভ্য শহরের কোনও অঞ্চলেই পথ অবরোধ করিয়া রাজনীতি চলিতে পারে না। পুলিশ কমিশনারের সিদ্ধান্তটি যদি শেষ পর্যন্ত কার্যকর হয়, তবে তাহা সভ্যতার পথে একটি বড় পদক্ষেপ হইবে। কিন্তু এই হতভাগ্য শহরে সত্যই কি রাস্তা-জোড়া জনসভা অতীত হইবে? রাজ্যে বর্তমানে যাঁহারা বিরোধী পক্ষ, তাঁহারা তো বটেই, শাসক দলের অন্যতম নেতা মুকুল রায় জানাইয়া দিয়াছেন তাঁহাদের ২১ জুলাইয়ের জনসভা যেমন হইত, তেমনই হইবে। যাঁহাদের উপর শহরের শৃঙ্খলাবিধানের দায়িত্ব, রক্ষকই যদি ভক্ষক হন, কলিকাতার সভ্য হইবার আশা থাকে কি? সরকারি অনুষ্ঠানের জন্য রাস্তা দখল করা চলিবে কি না, নগরপাল তাহা বলেন নাই। যে যুক্তিতে রাজপথ আটকাইয়া রাজনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ করা হইতেছে, সেই যুক্তিতেই সরকারি অনুষ্ঠানও পরিহার্য। কিন্তু, ক্ষমতা কেন বাধ্যতে?
শহরের রাস্তাকে রাজনৈতিক দখলমুক্ত রাখিবার সিদ্ধান্তকে বিরোধীরা ‘অগণতান্ত্রিক’ বলিয়াছেন। শব্দটি অতিব্যবহারে তাহার মাহাত্ম্য হারাইয়াছে, নেতারা কিছুমাত্র না ভাবিয়াই তাহা উচ্চারণ করিয়া ফেলেন। রাস্তার রাজনীতি এবং প্রকৃত গণতন্ত্রের মধ্যে ফারাকটি এমন সূক্ষ্ম নহে যে তাহা নজর এড়াইয়া যাইতে পারে। নেতারা রাস্তার রাজনীতির চটকে ভুলিয়া গণতন্ত্রের ধারণা হইতে এতটাই বিচ্যুত হইয়াছেন যে ফারাকটি আর চোখে পড়ে না। রাস্তা গণতন্ত্র অনুশীলনের প্রকৃষ্ট পরিসর নহে। তাহার জন্য আইনসভা রহিয়াছে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অনুপস্থিতিতে লোকসভা, বিধানসভার অধিবেশন দিনের পর দিন অর্থহীন হইয়া থাকে। গণতন্ত্রের চর্চাই যদি মোক্ষ হয়, তবে সেই পরিসর ব্যবহার করুন। তাঁহারা যে জনতার প্রতিনিধি, তাঁহাদের দাবি ও প্রশ্নকে যোগ্য সম্মান দিন। এই পরিসরের যোগ্য ব্যবহারই গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র। তাহাতে নাগরিকদের যাতায়াতের অধিকারটিও রক্ষিত হইবে।
কেহ প্রশ্ন করিতে পারেন, যাঁহাদের আইনসভায় আলোচনার অধিকার নাই, এমনকী গণমাধ্যমের পরিসরটিও যাঁহাদের নাগালের বাহিরে, তাঁহারা নিজেদের দাবি পেশ করিবেন কোথায়? যদি তাঁহাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সেই প্রতিনিধিত্ব করিতে ব্যর্থ হন, তবে কি তাঁহাদের নিজেদের কথা বলিবার অধিকার থাকিবে না? নিশ্চয়ই থাকিবে। শহরে হরেক সভাঘর আছে, প্রেক্ষাগৃহ আছে। নির্দিষ্ট মূল্যের বিনিময়ে সেগুলি ভাড়া পাওয়া যায়। তেমনই কোনও সভাঘর ভাড়া করিয়া তাঁহারা নিজেদের কথা বলুন, আলোচনা করুন। কেহ স্বেচ্ছায় আপন হলঘর বা গৃহও সভার জন্য ব্যবহার করিতে দিতে পারেন। রাস্তা যাতায়াতের জন্য, রাজনীতি-চর্চার জন্য নহে। এই কথাটি স্মরণে রাখিলেই সভ্যতার একটি বড় পাঠ আয়ত্ত করা সম্ভব। গণতন্ত্রেরও। |