একটি থানা এলাকার ঘটনা নিয়ে অভিযোগকারী অন্য থানায় চলে যেতেই পারেন। কিন্তু সেই অন্য থানার পুলিশেরই দায়িত্ব অভিযোগ নথিবদ্ধ করা। এমনকী, প্রয়োজনে অভিযোগকারীকে পুলিশের গাড়িতে চাপিয়ে নির্দিষ্ট থানায় পৌঁছে দিয়ে তাঁর অভিযোগটি নথিবদ্ধ করাতে হবে। মঙ্গলবার ক্রাইম কনফারেন্সে থানাগুলিকে এমনই নির্দেশ দিয়েছেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থ। লালবাজার সূত্রের খবর, সিপি জেনেছেন, অভিযোগ জানাতে গিয়ে বহু ক্ষেত্রেই অভিযোগকারীরা হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। প্রথমেই অভিযোগ না-নিয়ে একটি থানা থেকে অন্য থানা, আবার সেখান থেকে আর একটি থানায় তাঁদের পাঠানো হচ্ছে। এর প্রেক্ষিতেই সিপি-র এই নির্দেশ। এর পাশাপাশি জেনারেল ডায়েরি করতে কেউ থানায় এলে তাঁকে যেন দীর্ঘক্ষণ বসিয়ে রাখা না-হয়, এই নির্দেশও দিয়েছেন তিনি।
অভিযোগ, এক শ্রেণির পুলিশের দায়িত্ব এড়ানোর ফলে সাধারণ নাগরিকদের তো অসুবিধা রয়েছেই, তা ছাড়া পুলিশের দায়সারা তদন্তে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নির্দোষ, এমনকী প্রবীণ নাগরিকেরা পর্যন্ত চরম হয়রানির শিকার হচ্ছেন। বিনা অপরাধে হাজতবাস করতে হচ্ছে। সম্প্রতি যা হয়েছে ঠাকুরপুকুর থানা এলাকায় এক যুবকের অপমৃত্যুর ঘটনায়। লালবাজার সূত্রে খবর, এ দিন ওই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে গুরুত্বপূর্ণ মামলায় তদন্তকারী অফিসার ছাড়াও ওসি, এসি এবং ডিসি-দের ঘটনাস্থল পরিদর্শন বাধ্যতামূলক করে দেন সিপি।
এপ্রিলের গোড়ায় ঠাকুরপুকুরের কেনারাম গাঙ্গুলি লেনে সম্রাট চক্রবর্তী নামে বছর পঁচিশের এক যুবকের বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়। ছোটবেলায় মা-বাবাকে হারানো ওই যুবক ঠাকুরদা-ঠাকুরমা ও কাকার কাছে মানুষ। স্থানীয় একটি স্কুলে পড়ানোর পাশাপাশি পুজোআর্চার কাজও করতেন তিনি। সম্রাটকে বিষ খাইয়ে মারার অভিযোগে ঠাকুরপুকুর থানার পুলিশ প্রথমেই তাঁর ঠাকুরদা, ঠাকুরমা ও মধ্যবয়সী কাকাকে গ্রেফতার করে। তিন জন এখনও হাজতে।
ইতিমধ্যে লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের হোমিসাইড শাখা সমান্তরাল তদন্তে জানতে পারে, ওই যুবক মানসিক অবসাদে ইঁদুর মারার বিষ খেয়ে আত্মঘাতী হন। সম্রাটের ঘর থেকে সুইসাইড নোটও পান গোয়েন্দারা। যা প্রথমে ঠাকুরপুকুর থানার পুলিশের নজর এড়িয়ে গিয়েছিল। ওই প্রসঙ্গ টেনে ঠাকুরপুকুর থানার ওসি কুজল সরকারকে এ দিন ভর্ৎসনা করেন সিপি।
পুলিশ সূত্রের খবর, ওসি বলার চেষ্টা করেছিলেন, তদন্তকারী অফিসার তখন ছুটিতে চলে যান। কিন্তু এতে আরও ক্ষুব্ধ সিপি প্রশ্ন তোলেন, খুনের মামলা রুজু সত্ত্বেও এত দায়সারা তদন্ত হয় কী করে? তদন্তকারী অফিসার ছুটিতে থাকায় ওসি-র ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা অনেক বেশি জরুরি ছিল বলে পুলিশ কমিশনার মন্তব্য করেন। এই প্রেক্ষিতেই ওসি, এসি এবং ডিসি-দের ঘটনাস্থলে যাওয়া বাধ্যতামূলক করেন তিনি।
লালবাজারের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, “ঘটনাস্থল পরিদর্শন না-করে শুধু ঠান্ডা ঘরে বসে রিপোর্ট দেওয়াই এক শ্রেণির অফিসারের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। সে জন্যই ঠাকুরপুকুরের ওই বৃদ্ধ দম্পতির মতো আরও অনেকে বিনা অপরাধে হয়রান হচ্ছেন। সিপি-র আজকের নির্দেশে ওই অভ্যাস বদলায় কি না, সেটাই দেখার।”
আর এক ধরনের পুলিশি অভ্যাসের দরুণ কিছু দিন আগেই ভুগতে হয়েছিল এক বেসরকারি সংস্থার অবসরপ্রাপ্ত কর্মী, টালিগঞ্জের সমীর মুখোপাধ্যায়কে। ধর্মতলায় মোবাইল চুরির অভিযোগ তিনি নথিবদ্ধ করাতে যান নিউ মার্কেট থানায়। তাঁকে ময়দান থানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ময়দান থানা আবার জানায়, চুরির জায়গাটি শেক্সপিয়ার সরণি থানার আওতায় পড়ছে।
কলকাতা পুলিশের এক শীর্ষ অফিসার বলেন, “পুলিশ রেগুলেশনস অফ ক্যালকাটা অনুযায়ী, কেউ শহরের যে কোনও থানায় অভিযোগ জানাতে পারেন। যে থানার এক্তিয়ারে ঘটনাটি পড়ছে, সেখানে অভিযোগটি পাঠিয়ে দেওয়াটাও পুলিশেরই দায়িত্ব। অভিযোগকারীকে কোনও দায় নিতে হবে না। কিন্তু এক শ্রেণির পুলিশের দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলার অভ্যাসে অভিযোগকারীরাই হেনস্থা হচ্ছেন।” ওই অফিসারের বক্তব্য, “থানার গাড়িতে চাপিয়ে অভিযোগকারীকে অন্য থানায় নিয়ে যাওয়ার দাওয়াইতেই মনে হচ্ছে কাজ হবে। তখন অভিযোগ নিজেরাই নথিবদ্ধ করতে বাধ্য হবেন ওই অফিসারেরা।”
এ দিন সুরজিৎবাবু আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়ে বাহিনীকে বিশেষ ভাবে সতর্ক থাকারও নির্দেশ দেন। কলকাতা পুলিশের কর্মী-সংখ্যা প্রায় ২৭ হাজার। বাহিনীর প্রায় অর্ধেক কর্মী পঞ্চায়েত ভোটের সময়ে প্রায় ১০-১২ দিন বিভিন্ন জেলায় থাকবেন। সেই সময়ে অফিসারদের বাড়তি দায়িত্ব নেওয়া, রাস্তায় নিয়মিত টহলের নির্দেশ দিয়েছেন সিপি। তাঁর বক্তব্য, বাহিনী কম থাকার সুযোগে যাতে কেউ শহরে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাতে না-পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। |