কাল ছিল সেতু ভাঙা, আজ সবই ঠিকঠাক!
ট্রেনে কাটা পড়ে এক মহিলার মৃত্যুর জেরে অবরোধ, ভাঙচুর, পুলিশ-জনতা সংঘর্ষে ধুন্ধুমার কাণ্ড। সারি সারি ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকল তিন ঘণ্টা। তার পরেই টনক নড়ল রেল-কর্তৃপক্ষের। ভাঙচোরা যে-সেতু চার মাসেও মেরামত হয়নি, যেন জাদুমন্ত্রে সেই কাজ সারা হয়ে গেল রাতারাতি!
পথচারীদের জন্য হাওড়া স্টেশনের অদূরে সল্টগোলায় রেললাইনের উপরে একটি মাত্র ভাঙাচোরা ফুটব্রিজ। মেরামতির জন্য কিছু দিন সেটি বন্ধ ছিল। তাই রেললাইনের উপর দিয়েই যাতায়াত করতে হচ্ছিল বাসিন্দাদের। রোজকার মতো সোমবার সন্ধ্যাতেও পিলখানা থেকে টিকিয়াপাড়ায় নিজের বাড়িতে ফেরার জন্য বাধ্য হয়ে রেললাইন ধরে হাঁটছিলেন সালেয়া খাতুন (৫৫) নামে এক মহিলা। তখনই শেওড়াফুলি লোকালে কাটা পড়েন তিনি। তার পরেই শুরু হয় হাঙ্গামা।
খণ্ডযুদ্ধের উত্তেজনা নিয়েই ঘুমোতে গিয়েছিলেন এলাকার বাসিন্দারা। মঙ্গলবার ভোরে তাঁরা অবাক হয়ে দেখেন, সেতুটি সারানো হয়ে গিয়েছে। রেললাইনের উপরে যে-ভাঙাচোরা ফুটব্রিজ চার মাসেও সারানো হয়নি, মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সম্পূর্ণ করা হয়েছে সেই কাজ। এ দিন সকাল থেকে ওই ফুটব্রিজ দিয়েই যাতায়াত করছেন পথচারীরা।
কিন্তু যে-সেতু বন্ধ থাকায় রেললাইনের উপর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে প্রাণহানি ঘটল, রাতারাতি সেই ফুটব্রিজ সারানো হল কী ভাবে?
আসলে মঙ্গলবার রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী যে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাচ্ছেন, সোমবার রাতেই তা জেনে গিয়েছিলেন পূর্ব রেলের কর্তারা। তাই আর দেরি করেননি। গোলমাল মিটতে না-মিটতেই রাতে ওই সেতু মেরামতির কাজ চালু করার ব্যবস্থা করেন তাঁরা। এবং ভোরে কাজ শেষ করে দেখিয়ে দেন, সেতুটি একেবারে ঠিকঠাক! অধীরবাবুকেও তাঁরা জানান যে, সেতু মেরামতির কাজ শেষ করা হয়েছে সোমবার ভোরে। অর্থাৎ সেতুটি খারাপ হয়ে পড়ে ছিল বলে মানুষ যে-অভিযোগ করেছেন, তা ঠিক নয়।
হাওড়া স্টেশনের কাছে এই ফুটব্রিজটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উত্তর হাওড়ার পিলখানা থেকে মধ্য হাওড়ার টিকিয়াপাড়ার মধ্যে সংযোগকারী এই সেতু হাওড়া স্টেশনের পুরনো ও নতুন কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে আসা সব রেললাইনের উপর দিয়ে গিয়েছে। স্থানীয় বালিন্দাদের কাছে কাঠপুল নামে পরিচিত হলেও সেতুটি আসলে লোহার। সেতুটি দীর্ঘ দিন ধরে বেহাল অবস্থায় পড়ে ছিল। মরচে পড়ে ক্ষয়ে গিয়েছিল লোহার পাটাতন। নড়েবড়ে হয়ে গিয়েছিল সেতু। চার মাস আগে তার অবস্থা এমনই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে যে, তাতে চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। রেলের তরফে সেতু মেরামতি শুরু করা হয়েছিল। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই সেই কাজ বন্ধ হয়ে যায়। দু’দিকের মানুষ বাধ্য হয়েই প্রাণ হাতে করে রেললাইন টপকে চলাচল করতে থাকেন। যেমন করেছিলেন সালেয়া।
কাল্লু প্রসাদ নামে এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, “কাজ শুরু হলেও কবে শেষ হবে রেল কিছুই বলতে পারছিল না। এক সময় কাজ বন্ধ হয়ে গেল। আরপিএফ আমাদের সেতুতে উঠতে দিত না। অগত্যা রেললাইন টপকেই যাতায়াত করতাম।” স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, আরপিএফ-ও রেললাইন টপকে যাতায়াতে কোনও রকম বাধা দিত না। সেই জন্য বাড়ি বাড়ি পরিচারিকার কাজ সেরে সালেয়াও প্রতিদিনের মতো সোমবার রেললাইন টপকেই ঘরে ফিরছিলেন।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ওই মহিলার মৃত্যু হয়েছে আরপিএফের অমানবিকতার জন্যই। বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, ট্রেনের ধাক্কায় ওই মহিলার একটি পায়ের হাঁটুর নীচ থেকে কেটে যায়। তিনি রেললাইনেই পড়ে ছিলেন। তাঁকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেয়নি আরপিএফ। যাঁরা মহিলাকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন, লাঠি উঁচিয়ে তাঁদের তাড়া করা হচ্ছিল।
অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আরপিএফের সিনিয়র কম্যান্ড্যান্ট অ্যারোমা সিংহ ঠাকুর। তিনি বলেন, “এ-সব অভিযোগ মিথ্যা। আরপিএফ কাউকে বাধা দেয়নি।” প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুর্ঘটনার ২০ মিনিট পরে আরও একটি ট্রেন ওই মহিলার উপর দিয়ে চলে যায়। রেললাইনে দীর্ঘ ক্ষণ পড়ে থেকে মৃত্যু হয় তাঁর। আর ওই মৃত্যু দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে জনতা। তাতেই সম্বিৎ ফেরে রেল-কর্তৃপক্ষের।
একটি প্রাণের বিনিময়ে এক রাতেই শেষ হয় সেতু মেরামতি। |