চাকরি থেকে অবসর নিয়ে সবে বাড়ি ফিরেছিলেন আরপিএফ কনস্টেবল ধীরেন্দ্রনাথ হাঁসদা। তখনই পাড়ার গণ্ডগোলে জড়িয়ে পড়েন। রাগের মাথায় ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে মারেন এক যুবকের মাথায়। মৃত্যু হয় যুবকের। এবং ধীরেন্দ্রনাথের জেল।
অষ্টম শ্রেণির গণ্ডি পেরিয়ে আরপিএফে কনস্টেবলের চাকরিতে ঢুকে গিয়েছিলেন। অবসরের পরে খুনের অপরাধে জেলে গিয়ে এক রাশ হতাশা পেয়ে বসেছিল। সেটা ২০০৭ সাল। ফের পড়াশোনা করার জন্য জেল-কর্তৃপক্ষ তাঁকে উৎসাহ দিয়ে গিয়েছেন। প্রথম প্রথম মন সায় দিচ্ছিল না। ভাবতেন, এই বয়সে এসে পড়াশোনা করে কী-ই বা হবে! কিন্তু জেলের শিক্ষকেরা হাল ছাড়েননি। ক্রমাগত তাঁকে উৎসাহ দিয়ে গিয়েছেন। সেটা কাজে লাগল ২০১৩-য় এসে। ৬৯ বছর বয়সে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়েছেন ধীরেন্দ্রনাথ।
তাঁর নম্বর ২৫২, মধ্যশিক্ষা পর্ষদের হিসেবে গ্রেড ‘বি’।
ধীরেন্দ্রনাথের এই সাফল্যে স্বভাবতই উৎসাহিত কারা দফতর। আইজি (কারা) রণবীর কুমারের কথায়, “আমরা সব বন্দিকেই কিছু না কিছু করতে উৎসাহ দিই। তার জন্য পুরস্কারের এবং শাস্তি মকুবেরও ব্যবস্থা রয়েছে। এটা সংশোধনের একটা রাস্তাও।” ধীরেন্দ্রনাথ সেই রাস্তায় হেঁটে ৬৯ বছর বয়সে দুঃসাধ্য সাধন করেছেন বলেই মনে করছেন প্রেসিডেন্সি জেল কর্তৃপক্ষ। তাঁর সাজার মেয়াদ আরও চার বছর। মাধ্যমিক পাশ করার কৃতিত্ব তাঁরও সেই মেয়াদ মকুবের সুযোগ করে দিতে পারে বলে মনে করছেন কারা দফতরের অফিসারেরা।
শুধু ধীরেন্দ্র নন, এ বার ৫৭টি সংশোধনাগারের মধ্যে সাতটি থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন ১০৬ জন বন্দি। তার মধ্যে ১০৩ জনই কৃতকার্য হয়েছেন। সারা রাজ্যে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যেখানে পাশের হার ৮১.৮১%, সেখানে কারাগারের অন্দরে পাশের হার ৯৮.০৯%। কারা দফতর সূত্রের খবর, বন্দিদের মধ্যে যাঁরা মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে প্রথম হয়েছেন আলিপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের সাজাপ্রাপ্ত বন্দি ভদ্র মণ্ডল। ৩৯ বছর বয়সি ভদ্রের মোট প্রাপ্ত নম্বর ৫০৪। বাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার ভাঙড় থানার অমরেশ্বর গ্রামে। আট বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত ভদ্র ওই সংশোধনাগারে আছেন দু’বছর।
মাধ্যমিক উত্তীর্ণের তালিকায় এ বার নাম তুলেছেন মাওবাদী নেতা ছত্রধর মাহাতোর শ্যালক মানস মাহাতোও। তাঁর প্রাপ্ত নম্বর ৩২৩। মানস ছাড়াও আর সাত জন বিচারাধীন মাওবাদী বন্দি এ বার মাধ্যমিক পরীক্ষায় সফল হয়েছেন। তাঁরা হলেন কানাই হাঁসদা, ভন্টু হাঁসদা ওরফে রাজেশ, মঙ্গল সোরেন, সগুণ মুর্মু, বিষ্ণুপদ সোরেন, রামসাঁই হাঁসদা এবং গুরুচরণ মাহাতো। এঁরা সকলেই প্রায় দু’বছর ধরে মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে আছেন। কারও বাড়ি লালগড়ে, কারও বা বেলপাহাড়িতে।
কারা দফতরের কর্তারা এ বারের মাধ্যমিকের ফলে রীতিমতো খুশি। এক কারাকর্তার কথায়, “সংশোধনাগারে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা ক্লাস হয় বন্দিদের। দফতরের নিযুক্ত শিক্ষক ছাড়াও শিক্ষিত বন্দিরা তাঁদের বন্দিদের পড়ান। প্রয়োজনে সাহায্য করেন সংশোধনাগারের ওয়েলফেয়ার অফিসারেরাও।” কারা দফতর সূত্রের খবর, বই, খাতা এবং পড়াশোনার অন্য সরঞ্জাম আইজি-র দফতর থেকে বিলি করা হয়। দেওয়া হয় পরীক্ষার খরচও। ওই কর্তা বলেন, “বিচারাধীন বন্দিদের কাজ করতে হয় না। তাই দিনের যে-কোনও সময়েই পড়তে পারেন তাঁরা। কিন্তু দণ্ডিত বন্দিরা পড়ার সময় পান কম। বন্দিদের নির্দিষ্ট কাজ করার পরে পড়তে হয় তাঁদের। তাতেও তাঁদের উৎসাহ যে কম নয়, পরীক্ষার ফলই তার প্রমাণ।” |