তুষারঝঞ্ঝায় দু’জন খসে পড়তেই
বুঝলাম ফিরতে হবে
(ধৌলাগিরি অভিযাত্রী ও এভারেস্ট-বিজয়ী)
বিধি বাম!
কিন্তু এতটা যে বাম হবেন, বুধবার চার নম্বর ক্যাম্প থেকে রওনা দেওয়ার সময়েও সেটা বুঝিনি!
লক্ষ্য ধৌলাগিরি শৃঙ্গ।
আমরা তিনটে দল এগিয়ে চলছিলাম পরপর। সকলের আগে ছিলেন স্পেনের এক পর্বতারোহী, সঙ্গে এক শেরপা। তার পরে দু’জন শেরপাকে নিয়ে জাপানের এক মহিলা। ঠিক তাঁদের পিছনেই আমি, বসন্তদা (বসন্ত সিংহরায়), পেম্বা শেরপা এবং পাসাং শেরপা। চার নম্বর ক্যাম্পে ছিল হাওড়ার মলয় মুখোপাধ্যায় এবং অন্য এক শেরপা। ঠিক ছিল, আমরা ধৌলাগিরি শৃঙ্গে ওঠার পরে ওরা এসে যোগ দেবে।
ক্যাম্প থেকে বেরোনোর একটু পর থেকেই বাতাসের মতিগতি বিশেষ ভাল ঠেকছিল না। কিন্তু শৃঙ্গে উঠব, সেই রোখটা আমাদের ক্যাম্পে ফিরতে দিল না। এগিয়ে চললাম।
এক সময় তুষারঝড়ের দাপটটা বেড়ে গেল। তখন শৃঙ্গ থেকে ১০০ মিটার দূরে। ঠিক করলাম, এসেই যখন পড়েছি, শৃঙ্গ জয় না-করে থামব না। তুষারঝড়ের মধ্যেই আমি আর বসন্তদা ওয়াকিটকিতে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। আশা ছিল, ঝড় সামলে শৃঙ্গে ঠিক পৌঁছবই।
কিন্তু বিধি বাম!
পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল যে, পাহাড়ি চশমাটা চোখে রাখা যাচ্ছিল না। চশমাটা চোখ থেকে সরাতেই সব অন্ধকার হয়ে গেল! হাত-পায়ের আঙুলগুলোও অসাড়। তখনও মনে হচ্ছিল, উপরে পৌঁছতে পারব তো! ঠিক এই সময়েই একটা ঘটনা ঘটল। দেখলাম, স্পেনের ওই পর্বতারোহী এবং তাঁর সঙ্গী শেরপা হঠাৎই পাহাড় থেকে খসে পড়লেন নীচে।
সেই মুহূর্তেই ঠিক করলাম, আর নয়। এ বার ক্যাম্পে ফিরতে হবে। অথচ আর ঘণ্টা খানেক চড়তে পারলেই ধৌলাগিরি শৃঙ্গে উঠতে পারতাম। আসতে-যেতে বড়জোর দেড় ঘণ্টা লাগত। কিন্তু তুষারঝড়ের দাপট ভয়ঙ্কর ভাবে বাড়ছিল আর পাল্লা দিয়ে কাহিল হয়ে পড়ছিল আমাদের শরীর। তাই ঠিক করলাম, আর এগোব না। সেটা ঠিক কোন সময়, তা অবশ্য মনে নেই। আসলে তখন একটাই চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, যে-ভাবেই হোক, চার নম্বর ক্যাম্পে পৌঁছতে হবে। ক্যাম্পে জানালাম, আমরা ফিরছি। ওদের আর উপরে আসতে হবে না। এখন দেখছি, সেটাই উচিত সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ফেরার পথে চার জনের দলটি দু’ভাগ হয়ে গেলাম। এক দিকে আমি আর পেম্বা, অন্য দিকে বসন্তদা আর পাসাং। নামতে নামতে এক সময় বসন্তদার সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেল। ভাবলাম, চার নম্বর ক্যাম্পেই দেখা হবে। কিন্তু শুক্রবার সকাল সাড়ে ৭টা নাগাদ ক্যাম্পে ফিরে দেখলাম, বসন্তদারা ফেরেননি। মনে কু-ডাক। বসন্তদাকে ফিরে পাব তো?
আমি তখন চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। ফ্রস্ট বাইটে (তুষার-ছোবল) হাতে-পায়েও জোর নেই। কিন্তু মন বলছে, বসন্তদাকে তো এ ভাবে হারিয়ে ফেলা যাবে না! খবর পেলাম, স্পেনের ওই পর্বতারোহীর মৃতদেহ মিলেছে। তাতে ভয়টা আরও বেড়ে গেল। বেলা তখন ৩টে। খবর এল, বসন্তদার খোঁজ মিলেছে। একেবারে বিধ্বস্ত অবস্থায়। ওঁকে দড়ি বেঁধে নামানো শুরু হল।
বিধি যেন কিঞ্চিৎ প্রসন্ন!
শৃঙ্গে চড়ার সময় ভাগ্যের সাহায্য পাইনি। এ বার পেলাম। স্পেনের নিখোঁজ অভিযাত্রীকে খুঁজতে আকাশে হেলিকপ্টার চক্কর মারছিল। দড়ি বেঁধে বসন্তদাকে নামানো হচ্ছে দেখে সেই হেলিকপ্টার নেমে এল। তাতেই তুলে দেওয়া হল বসন্তদাকে। মন বলছিল, বসন্তদা বেঁচে যাবে। পাসাংয়ের অবশ্য তখনও খোঁজ ছিল না। ওকে ছাড়াই আমরা চার নম্বর ক্যাম্প থেকে নামতে শুরু করলাম। বেসক্যাম্পে পৌঁছে শুনলাম, বসন্তদাকে কাঠমান্ডুর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। আইসিসিইউ-এ রয়েছেন।
পোখরা পৌঁছেছি সোমবার। এখান থেকে এ দিনই কাঠমান্ডু ফেরার কথা। তার আগেই দু’টো ভাল খবর পেলাম। বসন্তদা আগের থেকে ভাল আছেন। আইসিসিইউ-এর বাইরে আনা হয়েছে তাঁকে। খোঁজ মিলেছে পাসাংয়েরও। নিখোঁজ হওয়ার পাঁচ দিন পরে! জন্মগত ভাবেই এ ধরনের প্রতিকূলতার সঙ্গে শেরপাদের লড়াই করার ক্ষমতা অন্যদের চেয়ে বেশি। সেই জন্যই বোধ হয় এ-যাত্রায় বেঁচে গেল ও। তবে সংক্রমণ হয়েছে বুকে। হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।
কাঠমান্ডুতে অপেক্ষা করছেন আমার স্ত্রী। রয়েছেন কয়েক জন বন্ধুও। আমি আর বসন্তদা সশরীরে কলকাতা না-পৌঁছনো পর্যন্ত ওঁরা নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না।
ধকল কাটিয়ে কবে যে ফের পাহাড়ে আসতে পারব, বুঝতে পারছি না। আফসোস, মাত্র ১০০ মিটারের জন্য অধরা থাকল ধৌলাগিরি!
তবে এক দিন না এক দিন ঠিক জয় করবই।

পুরনো খবর:




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.