নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
হাওড়ার উপনির্বাচনের প্রথম প্রচারে গিয়েই কংগ্রেসকে খোলাখুলি চ্যালেঞ্জ জানালেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সঙ্গে নিশানা করলেন বিজেপি-কেও।
ইউপিএ সরকার থেকে সমর্থন তুলে নেওয়ার পর গত অক্টোবরে জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রার্থী দেয়নি তৃণমূল। জোট ভাঙার পরে হাওড়াতেই প্রথম লোকসভা আসনে কংগ্রেস-তৃণমূল লড়াই হচ্ছে। সে দিক থেকে সোমবার কংগ্রেসকে তৃণমূল নেত্রীর তীব্র আক্রমণ বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।
তাঁর সরকারকে দিল্লির ইউপিএ সরকার নানা ভাবে উত্যক্ত করছে বলে অভিযোগ তুলে এ দিন বালির নির্বাচনী জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কী ভেবেছে কংগ্রেস! রোজ ষাঁড়ের মতো গুঁতোচ্ছে! কখনও আয়কর দফতরকে দিয়ে, কখনও সিবিআই দিয়ে, কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত সংস্থাকে আমাদের বিরুদ্ধে লাগিয়েছে।” এর পরেই তাঁর চ্যালেঞ্জ “আরে, এত গুঁতোতে হবে না! বাঘের বাচ্চা হলে ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করো, বুঝে নেব!” |
বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন এ রাজ্যের বাম সরকারের বিরুদ্ধে ৩৫৬ ধারা প্রয়োগের দাবিতে বহু বারই সরব হয়েছেন মমতা। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে দু’বছর পার করার পরে এ বার দিল্লির সরকারকেই সেই চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তৃণমূল নেত্রী আসলে কংগ্রেসকে সম্মুখ সমরে আহ্বান করেছেন বলে শাসক দল সূত্রের ব্যাখ্যা। বাম জমানায় রাজ্যের ঘাড়ে যে ঋণের বোঝা চেপেছিল, তার দায় তাঁকে কেন বইতে হবে বারেবারেই সেই প্রশ্ন তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। বারংবার সুদ মকুবের আর্জিও নাকচ হয়ে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ মমতা। তার উপরে সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের দাবিতে সরব হয়েছে কংগ্রেস। এই প্রেক্ষিতেই এ দিন হাওড়ার দলীয় প্রার্থী প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচারে এসে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কংগ্রেস ভাবছে হাওড়ায় তৃণমূলকে হারাতে পারলে পঞ্চায়েতে আমাদের শিক্ষা দিতে পারবে। কংগ্রেস জেনো রাখো, আমরা মানুষকে কেয়ার করি, আর কাউকে নয়!”
রাজ্যে লগ্নি সংস্থার বেআইনি কারবার নিয়ে সিপিএমকেই দুষেছেন মমতা। তবে বিষয়টি নিয়ে এ দিন বিস্তারিত ভাবে কিছু বলেননি। বরং সরব হয়েছেন কংগ্রেস-সিপিএম-বিজেপি’র ‘অনৈতিক আঁতাঁতে’র বিরুদ্ধে। হাওড়ায় এ বার বিজেপি প্রাথর্ীর্ দেয়নি। সেই সূত্রেই তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপি-র আঁতাঁতের প্রশ্ন প্রচারে এনেছে সিপিএম। রবিবারই হাওড়ার আন্দুলে প্রচারে গিয়ে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, তৃণমূলের হাত ধরে নরেন্দ্র মোদীর দল আবার এ রাজ্যে পা রাখার চেষ্টা করছে। সিপিএমের এই প্রচারের বিরুদ্ধে এ দিন মমতা পাল্টা বলেছেন, “সিপিএম-বিজেপি-কংগ্রেস একজোট হয়েছে। এরা সবাই এক হলেও কিছু করতে পারবে না! ওদের অনৈতিক জোট। আমাদের মানুষের মহাজোট!”
বিজেপি-র সঙ্গে গাঁটছড়া বাধার প্রচারে তাঁদের সংখ্যালঘু ভোট ব্যাঙ্কে সিপিএম বা কংগ্রেস যাতে থাবা বসাতে না পারে, সে দিকে লক্ষ রেখেই মমতা এ-ও বলেছেন, “বিজেপি সরাসরি লড়লে ভাল হত। কিন্তু ওরা দু’জন নির্দলকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে! ওদের একটাই অঙ্ক, তৃণমূলকে হারাতে হবে।” মমতার অভিযোগ, “ওই নির্দলদের মধ্যে এক জন থাকে বড়বাজারে। সে আবার হিন্দিভাষী। ওরা হিন্দি-বাঙালি ভাগাভাগি করতে চায়।” দলীয় সূত্রের খবর, দলের নেতা দীনেশ বজাজ ও বিজয় উপাধ্যায়কে হিন্দিভাষী বাসিন্দাদের মধ্যে প্রচারের দায়িত্ব দিয়েছেন মমতা।
রাজ্যে অল্প দিন সুযোগ পেয়েই তাঁরা শিল্পের পরিবেশ গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন বলে এ দিন বোঝাতে চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী তালিকা দিয়েছেন, রেল ও রাজ্যের দায়িত্ব পেয়ে গত চার বছরে কোথায় কোন প্রকল্প করেছেন। একই ভাবে দক্ষিণ কলকাতার হাজরায় বুদ্ধবাবুর সমাবেশের পাল্টা সভা থেকে এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো তথা তৃণমূল ‘যুবা’র সর্বভারতীয় সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জবাব চেয়েছেন, বাম জমানায় ক’টি শিল্প হয়েছে এবং কত কর্মসংস্থান হয়েছে। বাম জমানায় নতুন শিল্প কী হয়েছিল, বুদ্ধবাবুদের কাছে তার তথ্যও চেয়েছেন অভিষেক। ওই সভাতেই বুদ্ধবাবুকে কড়া জবাব দিয়েছেন তৃণমূলের মহাসচিব তথা রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও।
হাওড়ায় এ দিন বালি থেকেই মমতা উপনির্বাচনের প্রচার শুরু করেছেন। বস্তুত, এ দিন বালির সভায় তিনিই একমাত্র বক্তা ছিলেন। পাঁচলা ও আন্দুলে আজ, মঙ্গলবার দু’টি প্রচার সভা করার কথা মমতার। আগামী বৃহস্পতি ও শুক্রবারও তাঁর হাওড়ায় প্রচারের কর্মসূচি রয়েছে। প্রথমে যা পরিকল্পনা ছিল, এখন তৃণমূল নেত্রী হাওড়ায় তার চেয়ে বেশিই সময় দেবেন বলে ঠিক হয়েছে। সাধারণত, উপনির্বাচনের প্রচারে গত দু’বছরে মমতা এতটা গুরুত্ব দেননি। তৃণমূল নেতাদের একাংশের বক্তব্য, ক্ষমতায় আসার দু’বছরের মাথায় সাম্প্রতিক নানা ঘটনা নিয়ে বিরোধীদের ‘অপপ্রচারে’ পরিস্থিতি এমনই যে, জবাব দিতে দলনেত্রীকে ময়দানে নামতে হয়েছে। |
তৃণমূল সরকারের দু’বছরে রাজ্যে শিল্প আসেনি বলে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগের জবাবে এ দিন হাজরার পাল্টা সভা থেকে ব্যক্তি ও প্রশাসক দুই বুদ্ধবাবুকেই আক্রমণ করেন পার্থবাবু। পরিসংখ্যান দিয়ে তাঁর দাবি, বুদ্ধবাবুর মুখ্যমন্ত্রিত্বে ২২৩টি শিল্পের প্রস্তাব এসেছিল। বাস্তবায়িত হয়েছে ৫০টি। তবে এর মধ্যে খাতায়-কলমে রয়েছে মাত্র ২০টি। বুদ্ধবাবুর জমানার শেষ তিন বছরের বিনিয়োগের খতিয়ানের পাশাপাশি নিজেদের শিল্পায়ন-চিত্রও তুলে ধরেছেন শিল্পমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “এই দু’বছরে ২৬১টি সংস্থা বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। আমরা সম্মতিও দিয়েছি।”
শিল্পের তথ্য নিয়ে ‘জবাব’ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বুদ্ধবাবুকে হুমকিও দিয়েছেন পার্থবাবু। নাম না-করে বুদ্ধ-কন্যার এবং বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের স্ত্রীর স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নিয়ে তদন্তের হুমকি দিয়ে পার্থবাবু বলেন, “কে সাপ পুষল, হাতি পুষল, কার বৌ স্বাস্থ্য দফতরের বরাত পেয়ে সাত তলা বাড়ি করে ফেলল খাতা খুলব নাকি? তদন্ত হবে নাকি একটু?”
একই ভাবে পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ও এ দিন মহাকরণে প্রশ্নের জবাবে দাবি করেছেন, বুদ্ধবাবুর প্রচারের কোনও প্রভাব পঞ্চায়েত নির্বাচনে পড়বে না। সুব্রতবাবুর কথায়, “ওঁর ভাষণের আবার কী প্রভাব পড়বে? ওঁর ভাষণের যদি কোনও প্রভাব থাকত, তা হলে উনি তো আর নিজের নির্বাচন কেন্দ্রে (যাদবপুর) হারতেন না!” বর্ষীয়ান এই মন্ত্রীর আরও বক্তব্য, “৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার সময় সিপিএম গ্রামাঞ্চলে যে অত্যাচার করেছে, তা আর যাঁরাই ভুলুন, মাত্র দু’বছরে গ্রামের মানুষ সে সব দিনের কথা ভুলবেন না!” হাওড়ার প্রচারে মুখ্যমন্ত্রীরও বক্তব্য, বাম আমলে যে বালি ছিল সন্ত্রাসের আঁতুড় ঘর, সেখানে শান্তির পরিবেশ তাঁরা ফিরিয়ে আনবেন।
|