প্রবন্ধ ২...
আলট্রাসাউন্ড, না কি স্রেফ অযত্ন, অনাদর
শ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে দ্রুত কমছে শিশুকন্যার সংখ্যা। জনগণনায় দেখা যাচ্ছে, গত দশ বছরে রাজ্যের নয়টি জেলায় শহরাঞ্চলে মেয়েদের অনুপাত কমেছে, কিন্তু গ্রামাঞ্চলে তা কমেছে ১২টি জেলায়। বাঁকুড়া, দক্ষিণ দিনাজপুর, পূর্ব মেদিনীপুরে তো দেখা যাচ্ছে, শহরের চাইতেও গ্রামে মেয়েদের অনুপাত কম। তা বলে শহরেও মেয়েদের ঝুঁকি কম নয়। মোটের উপর এখনও শহরে শিশুকন্যাদের অনুপাত গ্রামের চাইতে কম। মালদহের শহরাঞ্চলে আশ্চর্য রকম কমেছে মেয়েদের সংখ্যা: ৯৪৩ থেকে এক লাফে নেমে হয়েছে ৮৮২, রাজ্যে যা সর্বনিম্ন।
ভারতে মেয়েদের সম্মান সামান্যই, তাই কন্যাসন্তান চায় না বহু পরিবার। জনসংখ্যায় দ্রুত কমছে মেয়েদের অনুপাত। অমর্ত্য সেন এদের আখ্যা দিয়েছেন ‘উধাও মেয়ে’ (মিসিং উইমেন)। জনসংখ্যা স্বাভাবিক নিয়মে বাড়লে এই মেয়েদের উপস্থিত থাকার কথা ছিল। কিন্তু গুনতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, তারা নেই। ১৯৯১ সাল থেকেই এ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। গর্ভের শিশুটি কন্যা বলে ধরা পড়লে তাকে বিনাশ করে দেওয়া হচ্ছে বলেই এত দ্রুত কমছে মেয়েরা, বলেছেন নানা বিশেষজ্ঞ। গর্ভস্থ শিশুর লিঙ্গপরীক্ষা নিষিদ্ধ করে আইনও হয়েছে। তবু শিক্ষিত, শহুরে, বিত্তবানরাই যে আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে নারী-নিধন করছেন, এই অস্বস্তি গোটা দেশে চারিয়ে গিয়েছে।
২০১১ সালে দেখা যাচ্ছে, গরিব জেলার গ্রামীণ পরিবারও এ বিষয়ে পিছিয়ে নেই। প্রাপ্তবয়স্কদের সংখ্যা নানা কারণে বাড়ে-কমে (যেমন বাইরে কাজে যাওয়া) তাই ছয় বছরের নীচে শিশুদের সংখ্যা থেকে মেয়েদের হাল আন্দাজ করেন বিশেষজ্ঞরা। গত বছরের শেষে জনগণনার সংক্ষিপ্ত ফল প্রকাশ হতে দেখা গিয়েছিল, ছয় বছর বয়স হওয়ার আগেই রাজ্যে ২ লক্ষ ৩৯ হাজার মেয়ে ‘উধাও’। তারা হয় জন্মায়নি, অথবা জন্মের পরে মারা গিয়েছে। সম্প্রতি আরও বিস্তারিত ফল প্রকাশ করল বিধাননগরের জনগণনা ভবন। দেখা যাচ্ছে, কন্যাসন্তানকে ‘উধাও’ করার প্রবণতা বাড়ছে গ্রামে।
যেমন উত্তর দিনাজপুর। সেখানে ১৯৯১-২০০১ সালের মধ্যে গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের অনুপাত কমেছিল হাজারে দু’জন। ২০০১-২০১১ সালের মধ্যে কিন্তু এক লাফে আরও ১৪ কমে দাঁড়িয়েছে ৯৫৩। পুরুলিয়াতে প্রতি হাজারে ১১ জন হারে কমেছে। মোট সংখ্যার হিসেবে উত্তর দিনাজপুরে এগারো হাজার, পুরুলিয়ায় আট হাজার শিশুকন্যা গ্রাম থেকে ‘উধাও’ হয়ে গিয়েছে। এই দরিদ্র জেলার গ্রামীণ পরিবারগুলিও হাঁটছে পঞ্জাব-হরিয়ানার পথে, যেখানে কন্যাশূন্যতা সমাজের নকশা বদলে দিচ্ছে।
প্রতি জনগণনাতেই নতুন নতুন প্রশ্ন সামনে আসে। এ বারে যা প্রশ্ন উস্কে দিচ্ছে তা হল, উত্তরবঙ্গে মেয়ে কমছে কেন? দার্জিলিং, কোচবিহার এবং উত্তর দিনাজপুরে মেয়েদের অনুপাত কমেছে আগের চাইতে দ্রুত হারে। দক্ষিণ দিনাজপুরের গ্রামে গত দুই দশকে প্রতি হাজারে ২৯টি মেয়ে কমেছে, যা গোটা রাজ্যে সর্বাধিক পতন (একই সংখ্যা নদিয়াতেও)। আর শহরগুলির অবস্থা আন্দাজ করতে গেলে দেখা যাচ্ছে, গত দশ বছরে উত্তরবঙ্গর শহরাঞ্চলে মেয়েদের গড় অনুপাত ৯৫৩ থেকে কমে হয়েছে ৯৩৫। দক্ষিণবঙ্গে সেখানে গড় অপরিবর্তিত, ৯৫১।
দক্ষিণবঙ্গের গ্রামাঞ্চলের ক্ষেত্রেও, অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধ জেলা হাওড়া, বর্ধমান, দুই মেদিনীপুরে গত দশ বছরে বেড়েছে মেয়েদের অনুপাত। কলকাতা, হুগলি আর দুই ২৪ পরগনার গ্রামে শিশুকন্যার অনুপাত কমলেও, আগে যত দ্রুত কমছিল তার তুলনায় এখন অনেক সামলে গিয়েছে হ্রাসের হার। এ থেকে ইঙ্গিত মেলে, কলকাতার আশেপাশে, তুলনায় সমৃদ্ধ জেলাগুলির চাইতে প্রত্যন্ত এবং দরিদ্র জেলায় শিশুকন্যাদের ঝুঁকি কিছু কম নয়।
এই ফলাফলের পর শিশুকন্যাদের অন্তর্ধানের কারণ নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে, বলছেন অর্থনীতিবিদ অচিন চক্রবর্তী। ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ-এর অধিকর্তা অচিনবাবু বলেন, “কন্যাভ্রূণ হত্যার প্রযুক্তি গ্রামের লোকেরা এত বিপুল ভাবে ব্যবহার করছেন, তা ধরে নেওয়া কঠিন। তাই বুঝতে হবে, হয়তো একটি পুত্র হওয়ার পরেই তাঁরা আর সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন না। না হলে জন্মের পর শিশুকন্যারা অকালে মারা যাচ্ছে বেশি। ঠিক কী ঘটছে, তা বোঝার জন্য জেলাগুলিতে শিশুমৃত্যুর সমীক্ষা প্রয়োজন।”
শিশুমৃত্যুর নকশা নিয়ে উদ্বিগ্ন ইউনিসেফের কনীনিকা মিত্রও। পুরুলিয়া জেলা হাসপাতালের নবজাতক ইউনিট (এসএনসিউ) ব্যবহারের পরিসংখ্যান থেকে তিনি দেখছেন, অসুস্থ কন্যাশিশুদের চাইতে অনেক বেশি অসুস্থ শিশুপুত্রদের আনা হয় এখানে। তার মানে, পুত্রসন্তানদের নিরাময় করতে টাকা, সময় ব্যয় করায় বেশি আগ্রহী পরিবারগুলি। মেয়েদের জন্য অত বিনিয়োগ করতে চায় না।
গত বছরের জাতীয় নমুনা সমীক্ষার (এস আর এস) পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে শিশুমৃত্যুর হার মেয়েদের ক্ষেত্রে হাজারে ৩৬, ছেলেদের ৩১। শহরে মেয়েরা ২৭, ছেলেরা ২৬। অর্থাৎ শহরে-গ্রামে শিশুকন্যারা মারা যাচ্ছে বেশি।
মনে হতে পারে, তফাতটা খুব বেশি কি? জনগণনাতেও গোটা রাজ্যের ছবি দেখলে ছেলে-মেয়ের পার্থক্য খুব বেশি মনে হয় না। রাজ্যে দশ বছরে শিশুকন্যার অনুপাত কমেছে চার একক, ৯৬০ থেকে ৯৫৬। অথচ রাজ্যওয়াড়ি এই আপাত-সমতার ছবির আড়ালে রয়েছে মালদহের শহরে ৯৪৩ থেকে ৮৮২, কোচবিহারের গ্রামে ৯৬৩ থেকে ৯৪৯, এমন সব আশঙ্কাজনক পতন। কেন এমন হচ্ছে, তা বোঝার উপায় হাতের কাছে নেই, কারণ এ রাজ্যে বার্ষিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা হয় না, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র বা হাসপাতাল থেকে তথ্য নিয়ে শিশুমৃত্যুর জেলাওয়াড়ি পরিসংখ্যান তৈরি হয় না, এ নিয়ে কোনও নমুনা সমীক্ষাও হয় না। ছবিটা আবছা বলে সমস্যার আড়বহর সম্পর্কে বোধটাও আবছা থেকে যায়। সমাধানও তৈরি হয় আবছা। আলট্রাসাউন্ড মেশিন নথিভূক্ত করো, মেয়েদের ছাত্রবৃত্তি দাও, সাইকেল দাও, চালাও সচেতনতা অভিযান। সর্বত্র সমস্যা এক হয়তো নয়, কিন্তু ব্যবস্থা গড়পড়তা। লাগলে ভাল, ফসকালে গেল। গ্রামে আর শহরে, উত্তরে আর দক্ষিণে, গরিবে আর ধনীতে যে তফাত রয়েছে, সে কথাটা নীতি-প্রকল্পের ছক কষার সময়ে কেউ আমল দেয় না। এ বারের জনগণনা তাই দ্বিতীয় যে কথাটি ভাবতে বাধ্য করছে, তা হল— গড়পড়তা এই বড় ছবিটার নীচে গিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চিত্র দেখা দরকার। শিশুকন্যার প্রতি অনাগ্রহ নানা সমস্যার বহির্প্রকাশ হতে পারে। সেগুলো কোথায় কী?
এখনই সে কথাগুলো নিয়ে ভাবতে না বসলে দশ বছর পরের সমীক্ষায় ধরা পড়বে, আরও কত মেয়ে গলে গেল গড়পড়তা নীতি-প্রকল্পের ফাঁক দিয়ে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.