প্রবন্ধ ১...
যার লড়াই, তাকেই একা লড়তে হবে?
বিগুলো গোড়া থেকেই কী যেন অস্বস্তি তৈরি করছিল। দিল্লির ছবি, সবগুলোই। কোথাও রাস্তা অবরোধ, কোথাও মেট্রো স্টেশন বন্ধ, কোথাও বড় বড় মিছিল। শিখ অবরোধ, শিখ মিছিল, শিখ বিক্ষোভ। ১৯৮৪ সালের দাঙ্গার বিচারের রায়ে সে দিনের অন্যতম অভিযুক্ত সজ্জনকুমার নিরপরাধ হিসেবে ঘোষিত, তারই প্রেক্ষিতে বেশ কয়েক দিন শহরজোড়া ক্ষোভ। এই ভয়াবহ অন্যায়ের প্রতিকার চাইছে ক্ষুব্ধ মুখগুলি। মুখগুলির পাশে প্ল্যাকার্ড, কিংবা হাতে-ধরা টুকরো কাগজ থেকে বোঝা যাচ্ছে, দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছিলেন যাঁরা, তাঁরা এঁদের কাছের লোক। একেবারে ঘরের বা পরিবারের না হলেও, এক অঞ্চলের, কিংবা এক গোষ্ঠীর, কিংবা এক সমাজের লোক।
এঁরা যে এক সমাজের লোক, সেটা বোঝার জন্য অবশ্য কষ্ট করে প্ল্যাকার্ড দেখার দরকার নেই। বাস্তবিক, ছবিগুলোর বিশেষত্বই এখানে। দৃশ্যমান প্রতিটি মুখই বলে দেয়, এঁরা কতখানি কাছাকাছি। শিখ দাঙ্গার অভিযুক্তদের বিচার, সেই বিচার নিয়ে আন্দোলন, ফলে আন্দোলনকারীদের তো হতেই হবে শিখ— এই সহজ সমীকরণটা ছবির মধ্যে প্রথম ছত্রেই বলে দেওয়া আছে। ছবি-জনিত অস্বস্তিটাও এখানে। আপনা থেকেই মনের মধ্যে ধাক্কা লেগে ওঠে: আচ্ছা? এ রকমই বুঝি হওয়ার কথা ছিল? গণতন্ত্র মানে আসলে নিজের নিজের ‘গণ’-এর কথা নিজেরা এগিয়ে এসে বলার জায়গা দেয় যে তন্ত্র, সেটাই?
আর কোনটাকে বলব ‘নিজের’, সেটাও এই রকমই পরিষ্কার? শিখরা বলবে শিখদের কথা, মুসলিমরা মুসলিমদের? কেবল গণতন্ত্র তো নয়, আমাদের এই ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র বলতেও তা হলে সেটাই বোঝায়? আশ্চর্যই বনতে হয়। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শই যে রাষ্ট্রের প্রত্যহ-পালনীয়, সেখানে কত স্বাভাবিক ভাবেই প্রতি দিন এই প্রকোষ্ঠ-বিক্ষোভ চলে, সেটাই বলে দেয় মে মাসের নিদাঘ-ধ্বস্ত দিল্লির রাজপথের ছবিগুলি।

এ রকমই বুঝি হওয়ার কথা ছিল? যার যার তার তার? না, তা বললে বোধহয় পুরোটা বলা হয় না। গণতন্ত্রের এই পরবাসে প্রত্যেক প্রকোষ্ঠই পৃথক নয়, কিন্তু যে প্রকোষ্ঠগুলি আমাদের গণতন্ত্রের ‘মার্জিন’-নিবাসী, সেগুলো বেশি পৃথক, সেগুলোর সংগ্রাম প্রায়শই আলাদা এবং একক। মূল/বৃহত্তর ধারার মানুষ যাঁরা, তাঁরা সাধারণত অতটা একা নন, প্রয়োজনে তাঁরা পেয়ে যান মার্জিন-কে। এই যেমন, দিল্লিতে অন্যান্য রাজনৈতিক বা সামাজিক আন্দোলনে সংখ্যালঘু অংশগ্রহণকারী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর নয়। অথচ, উল্টো দিকটা যে কতটা সত্যি, অর্থাৎ সংখ্যালঘুর উপর তুলনাহীন মারণযজ্ঞের ন্যায়বিচারের দাবিতে যে আন্দোলন, তাতে সংখ্যালঘু ভিন্ন অন্য মুখের অভাব যে কত বাস্তব— খবরের কাগজ বা টিভি চ্যানেলের ছবিই সেটা বলে দিচ্ছে!
গণতন্ত্রের প্রকোষ্ঠে? সজ্জনকুমারের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ,
দিল্লি, ২০১৩। ছবি: কমল সিংহ, পি টি আই
আর, কেবল দিল্লিই বা কেন? বিদেশেও শিখ সম্প্রদায় একই রকম সক্রিয়, সরব। নিউ ইয়র্কের ‘সিখ্স ফর জাস্টিস’ (এস এফ জে) শপথ নিয়েছে, তারা অভিযুক্তদের শাস্তি দিয়েই ছাড়বে। কয়েক সপ্তাহ আগে তৈরি হয়েছে ‘সিখ্ অ্যামেরিকান ককাস’, অভিবাসী শিখদের সংগঠন। ভারতীয় দূতাবাস বিরাট অস্বস্তিতে পড়েছে এই নতুন সংগঠনটি নিয়ে, কেননা ভারতে শিখদের উপর কী ধরনের ‘অগণতান্ত্রিক অবিচার’ চলছে, সেটা নিয়ে জনমত তৈরি করাই এই সংগঠনের লক্ষ্য। সজ্জনকুমার-রায় যেন হঠাৎই গোটা সম্প্রদায়কে একটা খাদের মুখে ঠেলে দিয়েছে, যা করার সব যেন তাঁদের এ বার নিজেদেরই করতে হবে।
এমন না ভেবে উপায় কী? সে দিনের রক্তবন্যা-বওয়ানো দাঙ্গায় নাকি দিল্লির রাস্তায় হেঁটে এলে জুতো ধুয়ে সাফ করতে হত, এত রক্ত লেগে যেত জুতোর তলায়। ‘দাঙ্গা’ বলা হচ্ছে বটে, কিন্তু আসলে তো একতরফা নিধনযজ্ঞ। সেই যজ্ঞের কিছু অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়ার পর লেখক অমিতাভ ঘোষের মনে হয়েছিল উনিশশো সাতচল্লিশ ‘অতীত’ হয়ে গেছে ভেবে বৃথাই তিনি বা তাঁর প্রজন্ম নিশ্চিন্ত বোধ করছিলেন, যে কোনও মুহূর্তেই যে সাতচল্লিশ আবার ঝাঁপিয়ে বাস্তব হয়ে উঠতে পারে তা দেখিয়ে দিল উনিশশো চুরাশি!
দু’হাজার তেরো-তেও সেই বিচারের প্রহসন চলছে তো চলছেই, তদন্তের নামে তদন্তহীনতা আজও প্রবহমান। তদন্তহীনতা বলাটা বাড়াবাড়ি নয় নিশ্চয়ই? প্রধান অভিযুক্ত জগদীশ টাইটলারের বিরুদ্ধে প্রধান সাক্ষী যশবীর সিংহকে নাকি ২০০৭ সালে সি বি আই খুঁজেই পায়নি, আর সি বি আই-এর নাকের ডগা দিয়ে তাকে খুঁজে বার করে ফেলেছিল এস এফ জে! সাক্ষীদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্যও এগিয়ে এসেছিল এস এফ জে-ই। যা করার নিজেদেরই করতে হবে, বোঝা যাচ্ছিল তখনই।
যেটুকু যা করার, নিজেদেরই করতে হবে, তাই আন্দোলনকারী শিখদের মধ্যেও সম্ভবত কোনও প্রত্যাশা নেই যে ‘অন্য’রা তাঁদের জন্য এগিয়ে আসবেন, আসতে পারেন। তাঁদের আন্দোলনকে অন্যদের কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনটাও তাই তাঁরা বোধ করেন না। আর, তাঁদের নাগরিক বিক্ষোভে ‘অন্য’ মুখের অভাবের সঙ্গে যখন এই প্রশাসনিক বিভ্রমের ইতিহাস ও তাঁদের হেনস্তার অতীত-বর্তমানের কাহিনিগুলি মিলে যায়, একটা বিশেষ বার্তা বেরিয়ে আসে সেই সামগ্রিক ছবি থেকে। বার্তাটি আমাদের গণতন্ত্রের বিষয়ে কিছু বলে, আমাদের সেকুলারিজম বিষয়েও কিছু বলে। বলে যে, এখনও এ দেশের জনপরিসরে কোনও গোষ্ঠী যদি তাদের নিজস্ব কোনও ক্ষোভ নিয়ে এগিয়ে এসে আন্দোলন তৈরি করতে চায়, গোষ্ঠী-বহির্ভূত বৃত্তে তা প্রায়শই ছড়িয়ে পড়ে না, ‘অন্য’দের অংশগ্রহণ পায় না, একটা সত্যিকারের গোষ্ঠী-অতিক্রমী আন্দোলন তৈরি হয়ে উঠতে পারে না। সামাজিক বা ধর্মীয় পরিচয়-চিহ্নিত গোষ্ঠীগুলির জন্য এ কথা বিশেষ ভাবেই সত্য। আর ঠিক সেই জন্য, ধর্ম-পরিচিতি, সমাজগোষ্ঠী-পরিচিতিগুলি ক্রমশই এ দেশে আরও শক্তপোক্ত হয়ে ওঠে।

অমিতাভ ঘোষের লেখার উল্লেখ এইখানেই জরুরি। শিখদের সেই দুঃস্বপ্নময় অভিজ্ঞতা যে কেবল তাঁদেরই একার অভিজ্ঞতা নয়, সেটা মনে করা জরুরি। যদি তা-ই হয়, যদি শিখনিধনের ইতিহাসের শরিক হয় অ-শিখ ভারতীয়রাও, তা হলে কেন অন্যদেরও দেখা যাবে না বিচারের দাবিতে রাস্তায় নামতে? অনেক দিন হয়ে গিয়েছে, তাই? শিখরা যদি ক্লান্ত না হন, এখনও সুবিচারের আশায় দিনযাপন করেন, তা হলে অন্যরা কেন ক্লান্ত বা নিরাশ হবেন? শেষ পর্যন্ত এটা কি তবে শুধু ‘শিখ-বিক্ষোভ’ই থেকে যাবে, তার চেয়ে বড় কিছু হতে পারবে না? গণতন্ত্রের ইতিহাসে উনিশশো চুরাশি কেবল সংখ্যালঘুর অন্যতম সংকট হিসেবেই লেখা থাকবে, গণতন্ত্রের সংকট বলে নয়? আর এর পরও আমরা অবাক হব, কেন এই গণতন্ত্রের মহান আধারে সংকীর্ণ ‘আইডেন্টিটি পলিটিক্স’ বা গোষ্ঠীসত্তা-নির্ভর রাজনীতির এত বাড়বাড়ন্ত? আমরা কি ভুলে যাব, গোষ্ঠী-রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোত যোগ সংখ্যার রাজনীতির, আর সংখ্যার রাজনীতির সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠের রাজনীতির?
উনিশশো চুরাশি কেবল শিখনিধনের কালই নয়, শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতিরও প্রান্ত-সময়। সেই বিচ্ছিন্নতাবাদের কিন্তু একটা মূল কথা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠতার সংস্কৃতির নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। আমরা সেই বিচ্ছিন্নতাবাদকে ঘৃণা করেছি, দমন করেছি। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ সংস্কৃতির হালচাল পাল্টাতে পারিনি। সমাজতত্ত্ববিদ পার্থ চট্টোপাধ্যায় একটি প্রবন্ধে মন্তব্য করেছিলেন, সংখ্যালঘুর পক্ষ নিয়ে কথা বললে এ দেশে গালাগালি শুনতে হয় ‘সিউডো-সেকুলার’— ‘সেকুলার’ নয়, কেননা, ‘সেকুলার’ বলতে ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা যা বোঝে, তার মধ্যে স্বীকৃত ভাবেই একটা সংখ্যাগরিষ্ঠতার সৌরভ আছে। অতিশয়োক্তি? কখনও। কখনও নিশ্চয়ই আমরা বলে উঠব— না, একটা সহিষ্ণু ধর্মনিরপেক্ষতার ধারাও আছে এই দেশেও, এই রাষ্ট্রের মধ্যেও। তবে কি না, একটা গণনিধনের বিচারের দাবিতেও যখন কেবল সংখ্যালঘু আক্রান্তদেরই দশকের পর দশক লড়ে যেতে দেখব, আর সমাজের বাকিরা অন্যমনস্কতা, উদাসীনতা কিংবা প্রতি-আক্রমণে ব্যস্ত থাকব, তখন কিন্তু কথাটা সত্যিই আর অতিশয়োক্তি থাকবে না, একেবারে যথার্থ হয়ে উঠবে।
দিল্লির ছবিগুলো ঠিক সেটাই বলছে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.