সরকার কোনও টেলিভিশন চ্যানেল অধিগ্রহণ করিতে পারে না— এই কথাটি কেন্দ্র জানাইয়া দেওয়ার পরেও রাজ্য সরকার ‘মানবিকতার খাতিরে’ ঘুরপথে দুইটি চ্যানেলের ভার গ্রহণ করিতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন আপাতত মুলতবি থাকুক। যাহা প্রশ্নাতীত, তাহা মুখ্যমন্ত্রীর সংবাদমাধ্যমপ্রীতি। পশ্চিমবঙ্গে বাণিজ্যিক ভাবে বিপন্ন সংস্থার অভাব ঘটে নাই। রাজ্য সরকার কি সেই সমস্ত সংস্থাকে সাহায্য করিতে হাত বাড়াইয়া দেয় বা দিবে? অমিত মিত্র কি গৌরী সেন? স্পষ্টতই, এমন ‘পাশে দাঁড়ানো’ কোনও সাধারণ নীতি নহে। টেলিভিশন চ্যানেলের প্রতি রাজ্য সরকারের বিশেষ দৃষ্টি রহিয়াছে। তাহা বিপজ্জনক। সংবাদমাধ্যম ‘গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ’ হিসাবে চিহ্নিত। সংবাদমাধ্যম নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক। রাজনৈতিক মহলের সহিত নৈর্ব্যক্তিক দূরত্ব বজায় না থাকিলে তাহা চরিত্রভ্রষ্ট হয়। সংবাদমাধ্যমের যেমন কথাটি স্মরণে থাকা বিধেয়, তেমনই গণতন্ত্রের আর একটি স্তম্ভের শীর্ষে অধিষ্ঠিত রাজনীতিকদেরও এই দূরত্বকে সম্মান করা কর্তব্য। গণতন্ত্রের সুস্বাস্থ্যের জন্য এই দূরত্বের বিকল্প নাই।
ভারতে এই দূরত্ব মাঝে মাঝেই ক্ষীণ হইয়া পড়ে। বামপন্থীদের দলীয় মুখপত্র তাহাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অঙ্গ। এই ক্ষেত্রে অন্যান্য দলগুলিও প্রায়শই বামপন্থীদের অনুসারী। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, অথবা তাঁহাদের ঘনিষ্ঠ জনেরা সংবাদপত্র, টেলিভিশন চ্যানেল খুলিয়া বসিয়াছেন। ইহা সংবাদমাধ্যমের নিরপেক্ষতার অনুকূল নয়। তাহার বিশ্বাসযোগ্যতাও ইহাতে বিপন্ন হয়। অবশ্য, মালিকানা ব্যতীতও যে সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা চলে, ১৯৭৫ সালে ভারতেই তাহার প্রমাণ মিলিয়াছিল। কিন্তু তাহা অপেক্ষা মালিকানা বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ সুবিধাজনক, তাহাতে গণতন্ত্রে হাটে হাঁড়ি ভাঙে না, কার্য সিদ্ধ হয়। মালিকানা বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে হউক অথবা ক্ষমতার দাপটেই হউক, রাজনীতিকরা দুইটি কারণে গণমাধ্যমকে দখল করিতে চাহেন এক, তাঁহারা যে পথে চলিবেন, তাহাই যে সর্বোত্তম, তাহা প্রচার করিবার জন্য; এবং দুই, তাঁহারা যে পথে চলিতেছেন, তাহা যে অতি বিপজ্জনক, সে কথাটি যাহাতে কোনও ক্রমেই জনসমক্ষে না আসিতে পারে, তাহা নিশ্চিত করিবার জন্য।
গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করিতে চাওয়ার পথটি গণতন্ত্রের বিপ্রতীপ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই পথে হাঁটিবেন কেন? তিনি গণতন্ত্রের রথে সওয়ার হইয়াই মহাকরণে পৌঁছাইয়াছেন। তাঁহার জনসমর্থনের ভিত্তি বহু রাজনীতিকের ঈর্ষার কারণ। তাঁহার নিশ্চয়ই সত্য গোপন করিবার প্রয়োজন নাই, প্রয়োজন নাই ‘সত্য নির্মাণ’-এরও। তবে কেন অহেতুক সংবাদমাধ্যমের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা? তাঁহার উপর রাজ্য পরিচালনার ভার ন্যস্ত। তিনি রাজ্যের উন্নতিসাধনে সক্ষম হইলে সংবাদমাধ্যম স্বাভাবিক ভাবেই সেই সংবাদ পরিবেশন করিবে। তাহার জন্য চ্যানেল অধিগ্রহণ করিতে হইবে না। আবার, সরকারি কাজের ত্রুটি থাকিলে সংবাদমাধ্যম সমালোচনা করিবে, তাহাও জরুরি। ইহাই গণতন্ত্র। |