ছত্তীসগঢ়ে রাজ্যের কংগ্রেস নেতাদের ‘পরিবর্তন যাত্রা’য় মাওবাদীদের ভয়ঙ্কর হামলায় হতাহতের সংখ্যা বাড়িয়াই চলিয়াছে। নিহতদের মধ্যে যেমন রহিয়াছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি, তেমনই নকশাল-বিরোধী জনজাতীয় মিলিশিয়া ‘সালওয়া জুড়ুম’-এর নেতা ও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মহেন্দ্র কর্মা। এই সংগঠনটিকে সুপ্রিম কোর্ট দুই বছর আগেই ‘বেআইনি ও সংবিধানবিরোধী’ ঘোষণা করিয়া ইহা ভাঙিয়া দিবার পরামর্শ দিয়াছিল। সালওয়া জুড়ুম-এর সর্বাধিনায়ক মহেন্দ্র কর্মা যে প্রদেশ কংগ্রেসের সহযোগী হিসাবেই ছিলেন, ‘পরিবর্তন যাত্রা’য় তাঁহার সক্রিয় ও সপারিষদ যোগদানই তাহার প্রমাণ। তাই বিজেপি নেতৃত্ব যখন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মাওবাদীদের প্রতি সহমর্মিতার অভিযোগ আনে, তখন তাহার বিশ্বাসযোগ্যতা লইয়া প্রশ্ন থাকিয়াই যায়। বিজেপি শাসিত ছত্তীসগঢ়ে মাওবাদীরা কেন কংগ্রেসের গোটা প্রদেশ নেতৃত্বকেই নিঃশেষ করিতে উদ্যত হয়, তাহার ব্যাখ্যাও এই অভিযোগে মেলে না।
ঘটনার পরেই প্রথমে কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধী ও রাত না পোহাইতে দলনেত্রী সনিয়া গাঁধী এবং প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের রায়পুর সফর দেখাইয়া দেয়, ইউপিএ সরকার ও কংগ্রেস হাইকমান্ড বিষয়টিকে কতটা গুরুত্ব দিতেছেন। ইহা হয়তো কেবল দলীয় মনোবল রক্ষার উদ্দেশ্যে নেতৃত্বের উদ্যোগ নহে, রাজ্য এবং জাতীয় রাজনীতিতে ভারতীয় জনতা পার্টির মোকাবিলার লক্ষ্যও এই সফরের পিছনে থাকা অস্বাভাবিক নহে। কংগ্রেস নেতৃত্বের তরফে ছত্তীসগঢ়ের মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহ তথা তাঁহার বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে প্রদেশ কংগ্রেসের রাজনৈতিক কর্মসূচিকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা না-দিবার অভিযোগ এই প্রেক্ষিতেই তাৎপর্যপূর্ণ। বস্তারের মতো জেলায় বিরোধী পক্ষ কংগ্রেসকে নিরাপত্তা দেওয়া যেমন সরকারের দায়িত্ব, তেমনই কংগ্রেস নেতৃত্বেরও দায়িত্ব ছিল এ ভাবে একসঙ্গে এবং প্রায়-অরক্ষিত অবস্থায় উপদ্রুত অঞ্চলে রাজনৈতিক কর্মসূচি রূপায়ণের হঠকারিতায় না যাওয়া। মাওবাদীরা যেখানে স্বয়ংক্রিয় একে-৪৭ বা একে-৫৬-এর মতো অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র এবং মাইন ও বিস্ফোরকে সজ্জিত, তখন কেবল দেহরক্ষীদের পিস্তল সম্বল করিয়া এমন বহুবিজ্ঞাপিত কর্মসূচি গ্রহণ কি আত্মঘাতী নয়? ঘটনার অব্যবহিত পরেই অবশ্য কেন্দ্রের ইউপিএ সরকার দুই হাজার অতিরিক্ত আধা-সামরিক বাহিনী পাঠাইয়াছে, প্রধানমন্ত্রীও সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়াছেন। কিন্তু নকশাল সন্ত্রাস দমনে সুসমন্বিত যৌথ তৎপরতার বিষয়টি অনেক আগে হইতেই চালু থাকা জরুরি ছিল। প্রধানমন্ত্রী নিজে যাহাকে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ রূপে একাধিকবার উল্লেখ করিয়াছেন, তাহার মোকাবিলায় এমন দায়সারা প্রশাসনিক ব্যবস্থাপত্র তো ব্যর্থ হইবেই।
হয়তো পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা ও অন্ধ্রপ্রদেশে মাওবাদী তৎপরতার সাময়িক হ্রাসে নকশাল সন্ত্রাসের বিপদ সম্পর্কে সতর্কতা ও প্রস্তুতিতে ভাটা পড়িয়া থাকিবে। ছত্তীসগঢ়ে তাহারই মূল্য চুকাইতে হইয়াছে। মাওবাদী জঙ্গি সন্ত্রাসের পথে চলিয়া যাওয়া জনজাতীয় তরুণদের ‘বিপথগামী’ ভাবিয়া তাঁহাদের সুপথে ফিরাইয়া আনার চেষ্টা চলিতেই পারে। কিন্তু স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অন্তর্ঘাত চালাইতে দেওয়ার মধ্যে আইনের শাসনকেই শিথিল করিয়া দিবার বিভ্রান্তি প্রকট। ইহার সুযোগ কিন্তু মাওবাদীরাই লইবে। যে আর্থসামাজিক বঞ্চনা, প্রতারণা ও শোষণ-নির্যাতন জনজাতীয় সমাজকে মাওবাদের দিকে আকৃষ্ট করে, তাহার অবসান ঘটানোর কর্মসূচি তো সালওয়া জুড়ুমের মতো সংগঠনের কখনও ছিল না। ইহা ছিল জনজাতিরই একাংশকে স্পেশাল পুলিশ অফিসার (এসপিও) বানাইয়া, আগ্নেয়াস্ত্রসজ্জিত করিয়া অন্য অংশের বিরুদ্ধে লড়াইয়া দিবার প্রকল্প। ইহা ব্যুমেরাং হইতে বাধ্য। ইহা জনজাতিকে বিভক্ত করিয়া তাহার সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংহতি বিনাশের প্রয়াসও। কঠোর প্রশাসন এবং যথার্থ সর্বজনীন উন্নয়ন এই দ্বৈত প্রক্রিয়াই সমস্যা মোকাবিলার একমাত্র সদুপায়। এবং তাহাতে প্রয়োজন সমস্ত গণতান্ত্রিক দল ও গোষ্ঠীর সম্মিলিত উদ্যোগ। মাওবাদী সন্ত্রাসের বিপদ কোনও বিশেষ দলের নয়। বিপদ সর্বজনীন। |