লাইনে দাঁড়িয়ে দরদর করে ঘামছিলেন বছর পঁয়তাল্লিশের নিরঞ্জন বিশ্বাস। কয়েক মিনিট আগেই খবর পেয়েছেন, মাধ্যমিকের মেধা তালিকায় প্রথম নামটি তাঁর ছেলের। উত্তেজনার কারণ অবশ্য শুধু সেটা নয়। পূর্বস্থলীর পারুলিয়া কুলকামিনী উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নিরঞ্জনবাবুর চোখে তখন ভাসছে বছর দেড়েক আগেকার অস্থিরতার দিনগুলো। কালনার মহারাজা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে স্কুলের মার্কশিটের খাম নেওয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে বলছেন, “শুধু আমার ছেলে নয়, গোটা স্কুলের ফলই ভাল হয়েছে। কাজটা কিন্তু খুব সহজ ছিল না।”
দেড় বছর আগে পারুলিয়ার এই স্কুলটি সংবাদ শিরোনামে এসেছিল। সে বারের কারণটা ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। এলাকার এক তৃণমূল নেতা খুনের ঘটনায় গ্রেফতার হন স্কুলের প্রধান শিক্ষক, সিপিএম নেতা প্রদীপ সাহা। প্রতিবাদে এক দিন স্কুল বন্ধ রাখা হয়। প্রিয় শিক্ষকের মুক্তি চেয়ে পথেও নেমেছিলেন স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা। প্রদীপবাবু অবশ্য এখনও জেলে। সেই অশান্ত সময়েই স্কুলে পরিচালনার ভার পান ইংরেজির শিক্ষক নিরঞ্জনবাবু। আস্তে আস্তে পরিস্থিতি পাল্টেছে। আঁধার কাটিয়ে আলোয় ফিরেছে তাঁদের স্কুল। |
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, স্কুলটি তৈরি হয়েছে ১৯৫০ সালে। প্রথমে ছিল ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত। পরে ধাপে ধাপে উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়। স্কুল কর্তৃপক্ষ জানান, আশপাশের কয়েকটি গ্রামের প্রাথমিক স্কুল থেকে আসা পড়ুয়াদের ভর্তি নেওয়া হয় কোনও পরীক্ষা ছাড়াই। তা সত্ত্বেও গত পাঁচ বছর ধরে মাধ্যমিক পরীক্ষায় এই স্কুলের ফল ঊর্ধ্বমুখি। গত পাঁচ বছরে প্রতি বার পাশের হার ৯৫ শতাংশের বেশি। গত বছরও ভাল ফল হয়েছিল স্কুলের। ৬৫৯ নম্বর পায় সৌরভ নন্দী। ২০১০ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে ৪৫৪ নম্বর পেয়ে জেলায় মেয়েদের মধ্যে সেরা হয় এই স্কুলেরই পূজা সাহা।
গ্রামের এক সাধারণ স্কুলের এমন ধারাবাহিক সাফল্যের কারণ প্রসঙ্গে সহকারী প্রধান শিক্ষক সুব্রত সামন্ত বলেন, “মূল কারণ শিক্ষকদের আন্তরিকতা ও শৃঙ্খলা। আমাদের স্কুলে যে সব পড়ুয়া ভর্তি হয়, তাদের অনেকে লিখতেও পারে না। তাদের ঘষামাজা করতে হয়। সেই স্কুল থেকে এ বার মাধ্যমিকে রাজ্যে প্রথম স্থান, আমাদের গর্বের সীমা নেই।” তিনি জানান, স্কুলের প্রথম সাত পিরিয়ড কখনও ফাঁকি যায় না। এক জন না এলে অন্য জন ক্লাস করেন। কোনও পরিস্থিতির প্রভাব পঠনপাঠনে পড়তে দেওয়া হয় না বলেই তাঁর দাবি। প্রদীপবাবু গ্রেফতার হওয়ার প্রসঙ্গ উঠলে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নিরঞ্জনবাবু বলেন, “শুরুতে খানিকটা সমস্যা হয়েছিল। তবে পড়ুয়াদের উপরে বিশেষ প্রভাব পড়তে দেওয়া হয়নি। এ বার একা সৌরাশিস নয়, অনেকেই ভাল ফল করেছে।” স্কুলের শিক্ষিকা অরুণা রায় জানান, সৌরাশিস ছাড়াও সৌরিতা সাহা, মন্দিরা সমাদ্দার ও শুভঙ্কর রাজবংশী ভাল ফল করেছে।
স্কুলের এমন সাফল্যের দিনে অনেকেরই মনে পড়ছে প্রদীপবাবুর কথা। পরিচালন সমিতির সম্পাদক রসময় চক্রবর্তীর কথায়, “রাজনীতির কথায় যাচ্ছি না। সে সব বাদ রেখে বলতে পারি, উনি এই স্কুলকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসেন। আজ তিনি স্কুলে থাকলে খুব আনন্দ পেতেন।” রসময়বাবু জানান, প্রদীপবাবুকে মঙ্গলবার নবদ্বীপ আদালতে তোলা হবে। সেখানেই স্কুলের এই খুশির খবর দেওয়া হবে তাঁকে। |