পুজোপাঠ নামমাত্র, ফুলদোলে মাতল নবদ্বীপ
দোলযাত্রা বা হোলি যদি রঙের উৎসব হয়, তবে চন্দন যাত্রা বা ফুলদোল নিঃসন্দেহে সুগন্ধের উৎসব। আর পাঁচটা বৈষ্ণবীয় উৎসবের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক এক উৎসব। ভক্ত আছেন, কিন্তু নেই ভিড়। আড়ম্বর আছে, কিন্তু নেই আত্মহারা উল্লাস। দেবতার পুজো নেই, আছে মগ্নভক্তের অনুচ্চ সমর্পণ। চন্দনযাত্রার মাধ্যমে বৈষ্ণব সমাজ যেন ফিরতে চান মাধবেন্দ্র পুরীর সময়ে।
ফুল-চন্দনে রাধাকৃষ্ণের সাজ। —নিজস্ব চিত্র।

গঙ্গার তরঙ্গে নৌকাবিহার
আকাশ ভেঙে নামছে মাধবী পূর্ণিমার দুধসাদা জ্যোৎস্না। তার বুকে ভাসছে এক অলৌকিক জনযান। জুঁই আর সাদা পদ্ম দিয়ে মোড়ানো সেই জলযানের উপর রূপোর বিরাট চতুর্দোলায় রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি। নৌকা চলছে নদীর পাড় ঘেঁষে। নদীর পাড়ে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ। চন্দন-জুঁই-আতরের গন্ধ ম-ম করছে। অলৌকিক জনযান থেকে ভেসে আসছে বসন্ত রাগে গীত কীর্তনের মোহিনী সুর। “পূর্ণিমা রজনী অতি মনোহর/ললিতা কহয়ে শুন রসিক শেখর/ তরণী উপরে আজ লইয়া তরুণী/ মণ্ডল বন্ধনে নৃত্যকর গুণমণি।”

বসন্ত উৎসবের শেষ রাত
বৈষ্ণব শাস্ত্রমতে বসন্ত উৎসবের সূচনা হয় শ্রীপঞ্চমীর রাতে। আর তা সমাপ্ত হয় বৈশাখী পূর্ণিমায়। তাই এই উৎসব আর এক দিক থেকে বসন্ত বিদায়ের উৎসবও। যার অন্য নাম ফুলদোল। রবিবার ছিল সেই ফুলদোল। সঙ্গে চন্দন যাত্রার সমাপ্তি। নবদ্বীপের হরিসভা মন্দিরের প্রধান বিবেকবন্ধু ব্রহ্মচারী বলেন, “বুদ্ধ পূর্ণিমা, চন্দন যাত্রার সমাপ্ত, ফুলদোল আবার এই তিথিতেই গৌরাঙ্গদেব এবং বিষ্ণুপ্রিয়াদেবীর বিয়ে হয়েছিল। সব মিলিয়ে রবিবার দুর্লভ তিথি ছিল।”

চন্দনং শীতলং লোকে
চন্দনযাত্রা বা ফুলদোল যে নামেই ডাকা হোক, বৈষ্ণব সমাজের এই উৎসবের সঙ্গে ভেষজ শাস্ত্রের সম্পর্কটা বড় নিবিড়। দেহ শীতল রাখতে চন্দনের ব্যবহার বহু প্রাচীন। অত্যন্ত গরমে দেবতার অঙ্গে চন্দনের পুরু প্রলেপ দিয়ে তাঁকে শীতল রাখার ব্যবস্থা হল চন্দনযাত্রার চুম্বকসার। সমাজবাড়ির পূর্ণদাস বাবাজী বলেন, “বৈষ্ণবেরা দেবতার আত্মবৎ সেবা করেন। অর্থাৎ বিভিন্ন ঋতুতে আমরা যে ভাবে নিজেদের গরম বা ঠাণ্ডা থেকে রক্ষা করি, দেবতার বেলায় সেই একই রকম। তাই মানবশরীরের মতোই রাধাকৃষ্ণকে চন্দন মাখিয়ে নৌকায় বিহারে নিয়ে যাওয়া হয়।”
বলদেব মন্দিরের কিশোর গোস্বামী বলেন, “চন্দন বা ফুলের সুগন্ধ এক শীতল অনুভব প্রদান করে। তাই মন্দিরগুলিতে এদিন ছিল ফুল-চন্দনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা।” মনোবিদদের কথায়, গন্ধ অনুসঙ্গের কাজ করে। মন্দিরের গন্ধে শান্ত ভাবের অনুসঙ্গ রয়েছে। গরমের সন্ধ্যায় জুঁই বা বেলফুলের গন্ধ আমাদের মানসিক ভাবে শীতল করে।

লক্ষ টাকার চন্দন কাঠ
নবদ্বীপ-মায়াপুরের বিভিন্ন মঠ-মন্দিরের এই উৎসব দীর্ঘ সময় ধরে চলে। সবচেয়ে বড় উৎসব হয় সমাজবাড়িতে। মায়াপুরের ইস্কন মন্দিরে ওই উৎসব চলে ২১ দিন ধরে। চন্দন-ই এই উৎসবের প্রধান উপকরণ। কত চন্দন লাগে? ইস্কনের জনসংযোগ আধিকারিক রমেশ দাস বলেন, “অক্ষয় তৃতীয়া থেকে উৎসবের শুরু। বৈশাখী পূর্ণিমায় শেষ। এ বছর ২০ কিলোগ্রিাম চন্দন কাঠ নিয়ে আসা হয়। ১০ হাজার টাকা কিলো দরে। উৎসবের এক সপ্তাহ আগে থেকে ভক্তরা যে যখন পারেন মন্দিরে এসে ওই কাঠ ঘষে চন্দন তৈরি করে পাত্র ভর্তি করেন।” চন্দনযাত্রার ২১ দিনে রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহকে এক-এক দিনে এক-এক রঙের চন্দনে সাজানো হয়সবুজ-হলুদ-নীল।

উৎসবের রঙ সাদা
সন্ধ্যা নামতেই উৎসবের সূচনা হয়। আর শেষ নদীতে। তিন কুইন্ট্যাল ওজনের প্রকাণ্ড চতুর্দোলায় ফুলে ফুলে সেজে, গ্যাসের বাতি, গোলাপ জলের ঝাড়ি, আতরদান নিয়ে চন্দন যাত্রার শোভাযাত্রা যখন সুগন্ধ আর সুর ছড়িয়ে নদীর দিকে এগিয়ে যায়, গভীর রাতের জনপদ তখন পাশ ফেরে। ভাঙে বাজার বছরের নিদ্রা। কোনও দিন ‘যমুনা’, কোনও দিন ‘মানস গঙ্গা’, আবার কোনও দিন ‘মানস সরোবরে’। পুরী, বৃন্দাবন আর নবদ্বীপে ভিড় করেন ভক্তরা। সুসজ্জিত ফুলের দোলায় নগর পরিক্রমার পরে দেবতা পৌঁছান সেই অলৌকিক জলযানে। তার পরে সারা রাত শুধু গান আর গানের মূর্চ্ছনা। নেই বৈদিক বা সংস্কৃত মন্ত্র। পুজোপাঠও নামমাত্র। বৈষ্ণব পরিভাষায় এর নাম বিলাসী-সেবা। তবে উৎসবের রঙ এখানে সাদা। দেবতাকে যখন সাজানো হয় সাদা ফুলে, তেমনি সেবকের পোশাকও সাদা। মন্দিরের বিগ্রহ সাদা পোশাকে আর মুক্তোর অলঙ্কারে সাজে। কিন্তু কেন? উত্তরে নরোত্তম দাস বাবাজী বলেন, “পূর্ণিমার সাদা রাতে কেবল সাদা পোশাক আর মুক্তোর গহনা পরেই অন্যের চোখকে ফাঁকি দিয়ে অভিসারে বের হওয়া যায়!”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.