উপনির্বাচনের ঠিক এক সপ্তাহ আগে হাওড়ায় দাঁড়িয়ে তৃণমূল এবং বিজেপি-র আঁতাঁতের অভিযোগে সরব হলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সরাসরিই বললেন, বিজেপি-র প্রার্থী সরে গিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের দল হিসাবে তৃণমূলকে রেখে গিয়েছেন! ভবিষ্যতের কথা ভেবে তৃণমূল-বিজেপি’র এই জোটের প্রয়াসকে পরাস্ত করতে হবে। সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্যের এই আহ্বানের পিছনে হাওড়ায় বামেদের সংখ্যালঘু সমর্থন পুনরুদ্ধারের চেষ্টাই দেখছে রাজনৈতিক শিবির।
আগামী রবিবার হাওড়া লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন। প্রচারের শেষ রবিবারে সাঁকরাইল বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে আন্দুলে বুদ্ধবাবু এসেছিলেন যথেষ্টই অসুস্থ শরীর নিয়ে। সাকুল্যে মিনিট কুড়ির বক্তৃতার অনেকটা অংশ জুড়েই ছিল বিজেপি এবং তৃণমূলের সমঝোতাকে তোপ। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “বিজেপি এখানে প্রার্থী দিয়েও প্রত্যাহার করে নিল। বেচারা অসীমবাবু (ঘোষ)! তাঁকে নামালই বা কেন, তুলেই বা নিল কেন? তার পরে দলটা নানা রকম কথা বলছে। কেউ বিশ্বাস করছে না, হাসাহাসি করছে! আসলে তারা (বিজেপি) সোজাসুজি তৃণমূলকে বলছে, আমাদের দরজা খোলা। প্রার্থী দিলাম না। তুমি (তৃণমূল) ঠিক করো, তোমার দরজা কি খোলা? আমরা বলছি, ওই দরজা কোনও দিন বন্ধ ছিল? না, ছিল না!” |
একই সুরে এ দিন বিজয়ানন্দ পার্কে নির্বাচনী সমাবেশে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র তৃণমূলের উদ্দেশে প্রশ্ন করেছেন, “কার সঙ্গে আছেন, স্পষ্ট বলুন! কংগ্রেস না বিজেপি?”
আন্দুলে বুদ্ধবাবু যোগ করেছেন, “বিজেপি-তৃণমূল আবার জোট হতে যাচ্ছে, এটা গুরুত্বপূর্ণ। সেই বিজেপি, যারা নরেন্দ্র মোদীকে সামনে আনছে। গুজরাতে দাঙ্গা-হাঙ্গামার দল আবার এ রাজ্যে তৃণমূলের হাত ধরে আসতে চাইছে। ভয়ঙ্কর!”
বুদ্ধবাবু সভা করে যাওয়ার পরে প্রত্যাশিত ভাবেই তার জবাব দিতে নামতে হবে তৃণমূলকে। আন্দুলেই দু’দিনের মধ্যে সভা করার কথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। গঙ্গার এ-পারে হাজরায় আজ, সোমবার বুদ্ধবাবুরই পাল্টা সমাবেশ থেকেও শাসক দল তাঁকে জবাব দেবে। তার আগে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিন বলেছেন, “বুদ্ধবাবুকে এখন ধূর্তবাবু বলা হচ্ছে! ওঁদের সঙ্গে কংগ্রেসের তলে তলে নয়, খোলাখুলি আঁতাঁত হয়েছে। বালি, উত্তর হাওড়ার মতো সিপিএমের শক্ত ঘাঁটিতে ওঁদের প্রচার দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। সেই সমঝোতা আড়াল করতে এখন বিজেপি-র তত্ত্ব নিয়ে এসেছেন!” বিজেপি-র হাওড়া জেলা সভাপতি শ্যামল হাতিও কটাক্ষ করেছেন, “আমরা প্রার্থী দিইনি বলে সিপিএম যদি এত চিন্তিত হয়, তা হলে তো তারাই বুঝিয়ে দিচ্ছে, তাদের চেয়ে আমাদের শক্তি বেশি!”
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য কংগ্রেসকে নিশানা করতে বাদ দেননি। কংগ্রেসের দুর্নীতি, বিজেপি-র সাম্প্রদায়িকতা এবং রাজ্যে তৃণমূলের অপশাসন এই তিনের বাইরে বিকল্প ভাবতে আবেদন করেছেন। বুদ্ধবাবু বলেছেন, “কংগ্রেসের যা অবস্থা, মনমোহন সিংহের যা অবস্থা বা দুরবস্থা! যদি এ রকম হয় যে, কংগ্রেস বা তৃণমূল জিততে পারল না? এই অবস্থায় এক জন বামপন্থী হাওড়া থেকে দিল্লি গেল। দেশের মানুষ চিন্তা করবে, আগামী দিনটা কি এই রকমই আসছে?”
যাঁকে জিতিয়ে বুদ্ধবাবুর এই বার্তা দেওয়ার আহ্বান, তিনিও সার্বিক পরিস্থিতির নিরিখেই এই উপনির্বাচনকে দেখতে বলছেন। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, হাওড়ার প্রাক্তন জেলা সম্পাদক এবং এ বারের লোকসভা প্রার্থী শ্রীদীপ ভট্টাচার্যের কথায়, “রাজ্য সরকারকে হুঁশিয়ারি, কঠোর সতর্ক-বার্তা দেওয়ার সময় এসে গিয়েছে। কোচবিহার থেকে বীরভূম, সব জায়গার মানুষ হাওড়ার দিকে তাকিয়ে আছেন।”
জেলায় এসে বালির নিহত তৃণমূল নেতা তপন দত্তের খুনের প্রসঙ্গ তুলে শাসক দল এবং প্রশাসনকে খোঁচা দিতে ছাড়েননি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। প্রশ্ন তুলেছেন, “জলাভূমি রক্ষা করতে গিয়ে তৃণমূল নেতাও খুন হয়ে যাবেন? এটা কী দল? কেমন চলছে পুলিশ-প্রশাসন?” প্রশাসক হিসাবে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর দক্ষতাকেও বিঁধেছেন প্রাক্তন। বলেছেন, “কিছু কাগজ চেষ্টা করেছে বোঝাতে, প্রশাসক হোন। কে কার কথা শোনে! সরকার ঘুরে বেড়াচ্ছে আর উৎসব করছে!”
হাততালির ঝড় উঠেছে আন্দুল রাজমাঠে। প্রায়ান্ধকার ময়দানে পোড়ো রাজবাড়ির সামনে রাজ্যের প্রাক্তন কর্ণধার যখন বলছেন, “পশ্চিমবঙ্গ অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। ত্রিফলা দিয়ে আলো জ্বালানো যাবে না! চতুর্দিকে অন্ধকার” তখনও হাততালি। প্রাক্তন শাসক অবশ্য তাতে ভোলেননি। মনে করিয়ে দিয়েছেন, “যত ক্ষণ না পর্যন্ত মানুষ বুঝতে পারছে তৃণমূল ভয়ঙ্কর দল, তত ক্ষণ কিছু হবে না। মানুষ তো তৃণমূলকেই এনেছিলেন। তৃণমূল যা খুশি করবে আর মানুষ সমর্থন করবে, হতে পারে না। মানুষ পরিবর্তন চাইবে!”
রাজ্যে ‘পরিবর্তনে’র কাণ্ডারী এ বার আন্দুলে গিয়ে কী বলেন, তারই অপেক্ষা! |