ইতিহাসের গর্ব আছে, যন্ত্রণা বদলাবে কি
শের শাহ সুরির তৈরি গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ভারতের কোন প্রান্তে সঙ্কীর্ণতম?
এটা যদি ডেরেক ও’ব্রায়েনের ক্যুইজের কোনও প্রশ্ন হয়, তার উত্তর কিন্তু খুব সহজ।
হাওড়া। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষুদ্রতম এই জেলায় রাস্তার এই হাল কিন্তু আজ হঠাৎ নয়। এ শহরে উপনির্বাচন দেখতে এসে আজ যা দেখছি, ঠিক তেমনটাই দেখেছিলাম সিকি শতাব্দী আগে। ফোরশোর রোডের ধারে ধারে খোলা নর্দমা থেকে ওঠা কালো পাঁকের পাহাড় এ বড় পরিচিত দৃশ্য আমার। দাশনগরে আলামোহন দাশের পূর্ণাবয়ব মূর্তি পাখির বিষ্ঠার আবরণে ধূসর।
এ জেলার প্রায় ২৮ ভাগ সংখ্যালঘু, তফসিলি জাতি-উপজাতি ১৬ থেকে ১৭ ভাগ। ওবিসি আলাদা। মনে আছে, অম্বিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাইকেলের পিছনে বসে প্রায় ২৫ বছর আগে পিলখানা বস্তি দেখতে গিয়েছিলাম। ‘টকাইদা’ তখন কংগ্রেসে। প্রলয় তালুকদার সিপিএম-বিধায়ক। আজ এত বছর পর সেই পিলখানা, সেই বেলগাছিয়া, সেই নন্দীবাগানের বস্তিতে গিয়ে দেখছি, পরিবর্তন কোথায়?
এই সেই হাওড়া কোর্ট। কোর্ট চত্বরে ব্যাঙের ছাতার মতো মাছভাতের ছোট ছোট দোকান। পুরনো অব্যবহৃত এসপি অফিস যেন খণ্ডহর। এই কোর্টেই প্রবীণ কংগ্রেস প্রার্থী সনাতন মুখোপাধ্যায়ের সেরেস্তা। ছোট ছোট খুপরি ঘরগুলোয় উকিল-মোক্তারের চেয়ার-টেবিল রাতে তালা-চাবি দিয়ে বেঁধে চলে যান আইনজীবীরা।
হাওড়া কোর্ট চত্বর।
চার পাশে কী ভয়ানক জঞ্জাল আর আবর্জনার স্তূপ! মাছের কানকো, আমের আঁটি, মশা-মাছি আর ডাবের খোলা এত নোংরা কোনও জেলা আদালত সম্ভবত এ রাজ্যে আপাতত নেই। কমলাকান্তের দপ্তরের এই চালচিত্র বদলাতে চায় জেলা প্রশাসন। কিন্তু তাদের অভিযোগ যখনই তাঁরা নতুন আদালত ভবন গড়তে উদ্যত হন, তখনই কিছু আইনজীবী রে রে করে আদালতে যান। জেলা প্রশাসনের অভিযোগ, একদা এই আইনজীবীদের কাছ থেকে মূল্য ধরে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। এখন সে সব লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ। কিন্তু আপাতত কোনও অর্থ ছাড়াই সবাই দিব্য আছেন। সংস্কারেই আপত্তি তাঁদের!
ভোটের বেশিদিন বাকি নেই! কিন্তু উপনির্বাচনে এমনিই উত্তেজনা কম থাকে। তার উপর এই ভোট শেষ হতে না হতেই ২ জুলাই জেলায় পঞ্চায়েত ভোট। পাঁচলা, সাঁকরাইল, জগৎবল্লভপুর আর ডোমজুড়ের একাংশে। শহর বা গ্রাম যাই হোক কোনও ক্ষেত্রেই বিপুল পোস্টার-ব্যানার-ফেস্টুন-দেওয়াল লিখন চোখে পড়ছে না। যেটুকু আছে তাতে দেখছি সর্বত্র মমতার ছবির পাশাপাশি সদ্যপ্রয়াত অম্বিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবিও ব্যবহার করেছেন ‘শ্রদ্ধাবনত প্রসূন’। মানে, তৃণমূল প্রার্থী প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়।
এই আপাত-নীরব ভোট পর্বে ১৪ লক্ষ ভোটারের কাছে প্রধান বিষয় কী? কী চান হাওড়ার মানুষ? কী চাইতে পারেন? এ হল সেই হাওড়া, যেখান থেকে মধ্যযুগে বেতড় বন্দর থেকে চাঁদ সওদাগর বাণিজ্যযাত্রায় যেতেন সিঁদুর লেপা বেতাইচণ্ডীর মন্দিরে পুজো দিয়ে। ইউরোপীয় পর্যটক সিজার ফ্রেডরিক খ্রিস্টীয় ষোলো শতকের মধ্যভাগে বেতড় ঘুরে লিখেছিলেন, শীতের সময় পর্তুগিজ বাণিজ্যের দৌলতে এখানে বসত বিরাট বাজার। হাওড়ার প্রথম জেলাশাসক উইলিয়ম টেলরও বলেছিলেন হাওড়া অর্থনীতির এক ভরকেন্দ্র। ব্রিটিশ যুগে ডক-দড়ি তৈরির কারখানা থেকে শুরু করে জাহাজ সারাই কারখানা, চটকল, তেলকল, ধাতুশিল্প, করাতকলের কেন্দ্রভূমি ছিল হাওড়া। ব্রিটিশদের কুলিটাউন।
হাওড়াবাসীর অহঙ্কার, এই তো সেই হাওড়া যেখানে বাজেশিবপুরে শরৎচন্দ্র থাকতেন তো বেলুড়ে বিবেকানন্দ! মৃত্যুর আগে স্বামীজি হাওড়া আদালতেই বেলুড় মঠের জমির রেজিস্ট্রি করতে এসেছিলেন! আর সেই হাওড়ায় কিনা জল নেই! জঞ্জাল-আবর্জনার হাত থেকে মুক্তি নেই! সালকিয়া-গোলাবাড়ি থেকে রামকৃষ্ণপুর অবধি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সুদীর্ঘ বেআইনি বাড়ি। ১৯৭৭ সালে কর্পোরেশন করে সিপিএমের আলোকদূত দাস হয়েছিলেন মেয়র। আজও সেই পুরসভা সিপিএমের দখলে। কিন্তু পুর-স্বাচ্ছন্দ্য? প্লিজ, এ শহরে ও সব কথা বলবেন না। কলকাতার ইতিহাস ৩০০ বছরের প্রাচীন। গঙ্গার পশ্চিম তিরে ৫০০ বছরের প্রাচীন হাওড়া শহরের মানুষ আজ বড় ক্লান্ত।
বেআইনি বাড়ি থেকে সম্পত্তি কর যথেষ্ট আদায় হচ্ছে না বলে রাজ্য প্রশাসন ক্ষুব্ধ। আর সিপিএমের অভিযোগ, পুরসভাকে ভাতে মারছে রাজ্য সরকার। টাকা দিচ্ছে না। তাই উন্নয়ন হচ্ছে না। কিন্তু সঙ্গত প্রশ্নটি তুলেছেন হাওড়ার এক প্রাচীন নাগরিক, মন্দিরতলার শ্যামল ঘোষাল। তাঁর বক্তব্য, “হাওড়ার যেটুকু উন্নতি হয়েছে তা হয়েছে যুগের প্রাকৃতিক নিয়মে। তৃণমূল তো রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছে দু’বছর। সিপিএম ৩৪ বছর মহাকরণে ছিল। সেই ১৯৭৭ সাল থেকেই তারা হাওড়া পুরসভায়। শহরটা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গিয়েছে।”
হাওড়া ময়দানে শরৎ সদন হয়েছে। বিগবাজার, মোটর গাড়ির শোরুম। মায়াপুরী-অলকার মতো সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। শ্যামাশ্রী বন্ধ। যোগমায়া সিনেমাহল ভেঙে তো এখন জেলা সিপিএমের সুদৃশ্য সদর দফতর। যোগমায়ার কাছে চিরকাল নোংরা শূকর কর্দমাক্ত রাস্তায় ঘোরাঘুরি করত। সেখানে সিপিএম অফিসটাই বরং যেন বেমানান। বস্তিতে ডিশ-অ্যান্টেনার মতো। কিন্তু সিপিএম প্রার্থী শ্রীদীপ ভট্টাচার্যর এলাকায় ভাবমূর্তি কিন্তু উজ্জ্বল। তিনি শিক্ষিত, ভাল মানুষ বলে পরিচিত। মারদাঙ্গা করার লোকই নন। শিল্পায়ন-উন্নয়ন নিয়ে বিতর্ক করেন। কিন্তু সিপিএম-ও জানে এ বার ভোটপ্রচারে তাদের প্রার্থী নন-ইস্যু। সিপিএম প্রচার করছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধেই। দু’বছরে যে অসন্তোষের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তাকে উস্কে দিতে চাইছে সিপিএম। তাই সর্বত্র তাদের পোস্টার বলছে সারদা-কাণ্ডে সিবিআইয়ের দাবিতে সিপিএম প্রার্থী শ্রীদীপ ভট্টাচার্যকে ভোট দিন। রামরাজাতলার বাসিন্দা আইনজীবী দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “সারদা কাণ্ড এখন হাওড়া ভোট প্রচারে প্রধান ইস্যু। এই ভোটের ফলাফল মমতা সরকারের প্রথম লিটমাস পরীক্ষা।”
১৪ লক্ষ মানুষের মধ্যে কত লোক ভোট দেন, সেটাও দেখতে হবে। সাধারণত হাওড়ায় শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ ভোট দেন। এই ক্ষুদ্র জেলায় ভোটার খুবই সক্রিয়। সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রের সাত জনই তৃণমূলের। তৃণমূল নেতাদের অনেকের ধারণা, সেটাও এক সমস্যা। বালির সুলতান সিংহ বা শালকিয়ার অশোক ঘোষ বা ডোমজুড়ের রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে যদি এলাকার মানুষের ‘অ্যান্টি-ইনকামবেন্সি’ জমা হয়, তবে তার ফলও ভুগতে হবে প্রসূনবাবুকে।
তবে ফুটবলার প্রসূনের সুবিধা তিনি হাওড়াবাসী নন। কাজেই প্রয়াত অম্বিকা বন্দ্যোপাধ্যায় অথবা কোনও মন্ত্রী বা কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সঙ্গে তিনি যুক্ত বলে পরিচিত নন। একদা প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি বলদনগরী বলে পরিচিত হাওড়া শহর থেকে জিতেছেন এবং হেরেছেন। তিনিও হাওড়াবাসী ছিলেন না। হাওড়ার মানুষ প্রিয়বাবুকে সুযোগ দিয়েছিলেন। বহিরাগত হলে হাওড়ার মানুষ সুযোগ দেন না, তা নয়। প্রসূনবাবুও তাই বলছেন, পরীক্ষা প্রার্থনীয়।
আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় জেলাশাসক হয়ে বন্দর আর পুরসভার বিবাদ ঘুচিয়ে ফোরশোর রোড আর জিটি রোডকে ওয়ান-ওয়ে করেছিলেন, নন্দিনী চক্রবর্তী হাওড়া হাটের উন্মুক্ত প্রসারণ, যেটি বঙ্কম সেতুতেও ধাবিত ছিল তা বন্ধ করেছিলেন। আজকের জেলাশাসক শান্তনু বসু পুরসভা, জেলাপরিষদ, জেলা প্রশাসন, হাওড়া ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের সমন্বয় সাধনে ব্যস্ত। পামপুকুর জলপ্রকল্পের নতুন ইউনিট তৈরি হয়ে গেলেও বিদ্যুৎ না আসায় তা ভোটের মুখে চালু হতে হতেও চালু হয়নি। আচ্ছা গেরো!
কংগ্রেস-তৃণমূলের মধ্যে এ বার জোট হয়নি। সিপিএম এই অঙ্কের ভরসায় ভোট লড়ছে। কংগ্রেস ভাবছে, প্রাচীন স্বচ্ছ ভাবমূর্তির পুরনো কংগ্রেসি নেতা যদি মানুষের সিপিএম-বিরোধী মানসিকতায় আগুন উসকে দিতে পারেন! বিজেপি আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রার্থী না দিলেও দু’টি নির্দল প্রার্থীর প্রতি নাকি রাজ্য বিজেপির পরোক্ষ আশীর্বাদ রয়েছে।
এমত অবস্থায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি আস্থায় কিন্তু ঘাটতি নেই। তৃণমূলের কর্মীরা বলছেন, ‘‘দাঁড়ান, দাঁড়ান, এখন তো কলির সন্ধে। দিদি তো এখনও হাওড়ায় সভা করতেই আসেননি। হাওড়ার মানুষের কাছে এসে দিদি কী বলবেন, সেটাই দেখার অপেক্ষা!’’



হাওড়া উপনির্বাচনের প্রচার চলছে জোরকদমে। তৃণমূল প্রার্থী প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়।



শিবপুরে সিপিএমের প্রচারে প্রার্থী শ্রীদীপ ভট্টাচার্যের সঙ্গে রয়েছেন সব্যসাচী চক্রবর্তী।

—নিজস্ব চিত্র



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.