|
|
|
|
কবি হলেন ফিক্সার
ভারতীয় দলের হয়ে সেটাই ছিল তাঁর প্রথম সাক্ষাৎকার। সৌম্য, বিনীত এক তরুণ।
বেশ আলাদা। যাঁকে দেখলেই মনে হয় লম্বা দৌড়বে। শান্তাকুমারন শ্রীসন্ত
সম্পর্কে নিজের ব্যর্থ পূর্বাভাসের স্মৃতিচারণায় গৌতম ভট্টাচার্য |
উইং কম্যান্ডার বালাদিত্য তখন ভারতীয় দলের মিডিয়া ম্যানেজার। রাহুল দ্রাবিড় যাঁকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করতেন, কী করে ফাইটার প্লেন ওড়াতে হয় বলো তো? সেই বালাদিত্য হাতে করে নিয়ে এলেন তরুণকে। বললেন, “ওর ঘরে যাবেন কী? ও-ই এসে ইন্টারভিউ দেবে।”
নাগপুরের প্রাইড হোটেল, ২০০৫ অক্টোবর। দোতলার কোণার ঘর। শেষ বিকেল। নিউজ চ্যানেলে ক্রমান্বয়ে শান্তাকুমারন শ্রীসন্তের বিহ্বল মুখ দেখতে দেখতে প্রাইডের সেই ঘরটা মনে পড়ছিল। বহু বছর বাদে বালাদিত্যকেও! শ্রীসন্ত পরের দিন গ্রেগ চ্যাপেলের ভারতের হয়ে প্রথম ম্যাচ খেলবেন। নতুন অধিনায়ক। সেই তিনি যাঁকে রাজস্থান রয়্যালসে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে ছাড়লেন— দ্রাবিড়! সাক্ষাৎকারটাও ছিল টিম ইন্ডিয়ার হয়ে তাঁর প্রথম। দেখেই মনে হচ্ছিল সাংবাদিকে এ একেবারে সড়গড় নয়। এর মিডিয়ার সঙ্গে সময় লাগবে।
দুপুরে প্র্যাকটিসেও লক্ষ্য করছিলাম, এই ছেলেটা যেন অন্য রকম। টিপিক্যাল মেড ইন মুম্বই বা মেড ইন কোচিং ক্যাম্প ছাপ নেই। প্রতি বার যখন মাঠে ঢোকে ঘাস ছুয়ে প্রণাম করে ঢোকে। যা এত বছর কোনও ক্রিকেটারকে করতে দেখিনি, ফুটবলাররা করে থাকে। শ্রীসন্তের কি ব্যাকগ্রাউন্ডে কোথাও ফুটবল আছে? মাথা ঝুঁকিয়ে নরম গলার তরুণ বলল, “না, ব্যাকগ্রাউন্ডে নাচ আছে। এই অভ্যেস আমার নাচের কেরিয়ারের। প্রতি বার নাচতে ওঠার সময় মঞ্চ প্রণাম করে উঠতাম। ক্রিকেট মাঠটাও আমার কাছে একটা রঙ্গমঞ্চ।” কথা বলতে বলতে জানা গেল, কিছু দিন আগেও শ্রীসন্ত নাচকেই জীবিকা করবেন ভেবেছিলেন। স্কুল পর্যায়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাচতেন। বাড়ির শো-কেসে ক্রিকেটের ট্রফি না থেকে নাচের ট্রফি ছিল।
আচ্ছা, গ্রেগ চ্যাপেলের ড্রেসিংরুম থেকে ইন্ডিয়া ক্যাপ পরে বেরোনোর সম্ভাব্য কোনও টেনশন হচ্ছে না? তরুণ বলল, “হচ্ছে না। আসলে মঞ্চে অনেক লাইভ শো করেছি তো প্রচুর দর্শকের সামনে। কালকের ব্যাপারটাও সে রকমই লাইভ শো।” অভিষেক ম্যাচে টার্গেটও বলে দিল— তিন উইকেট। এরই সঙ্গে নতুন বলে উইকেট নেওয়া। নতুন ছেলেটি আর বলল, “দাদা দেখা হলেই খুব উৎসাহ দেয়। ওকে এখানে মিস করছি।”
শ্রীসন্ত ঠিক একতলা ওপরে নিজের ঘরে ফিরে যাওয়ার ফাঁকে মনে মনে একটা পূর্বাভাস করে ফেলি। এই ছেলেটা লম্বা রেসের ঘোড়াই শুধু নয়। কোনও এক দিন অবধারিত ভারতের পেস বোলিং ভবিষ্যৎ হবে। এর যে দেখার ধরণটাই আলাদা। খুব ফ্রেশ। আর টিপিক্যাল সঙ্কীর্ণতায় আছন্ন নয়। থাকলে কী আর ঘোর চ্যাপেল জমানায় সদ্য অপসারিত গাঙ্গুলির প্রশংসা করে? কয়েকটা ম্যাচ পরেও দেখলাম, সেই প্রণাম করে মাঠে নামা। আর প্রণাম করে ফেরা। এরই মধ্যে ডেলিভারির সময় বলের সিম সোজা রেখে ফলো থ্রু-র জন্য বিশেষজ্ঞদের প্রশংসা কুড়োতে শুরু করে দিয়েছেন শ্রীসন্ত। কেরল পেসারের প্রথম সাক্ষাৎকার নেওয়া আমার কিন্তু আরও অভিভূত লাগছে অন্য কারণে। শুনলাম শ্রীসন্ত নাকি একটা কবিতার বই লেখা প্রায় শেষ করে ফেলেছেন।
মনে মনে ভাবছি অত কম বয়সেই যে বলেছিল, ক্রিকেট মাঠটা একটা রঙ্গমঞ্চ। তার দৃষ্টিভঙ্গিতে একটা স্বকীয়তা থাকবেই। সে লোকটা এতই বিশুদ্ধ যে মাঠকে প্রণাম করে নামে। সে যে কবিতা লিখবে তাতে আর বিচিত্র কী! একটা কবিতা এক দিন পড়েও ফেললাম। পড়ে মনে হল, কলকাতা লিটল ম্যাগাজিনে চান্স পেতে হলেও কোনও দাদাকে ধরতে হবে। ‘দেশ’ বা ‘সানন্দা’ তো অনেক দূরের গ্রহ। কিন্তু তাতে কী? একটা ক্রিকেটার নাচের ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছে। এসে কবিতা লিখছে, সেটাই তো বিভোর করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। এরই মাঝে সচিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটজীবনের কুড়ি বছর পূর্তি। শ্রীসন্ত তিনি কি একটা কবিতা লিখে দিতে পারেন আনন্দবাজারের সচিন স্পেশ্যাল ক্রোড়পত্রের জন্য? শ্রীসন্ত বললেন, “হাফ তো লিখেই রেখেছি। কাল বাকিটা দিয়ে দেব। আমার কবিতা ছাড়া কিন্তু বই ছাড়বেন না।”
সেই বাকিটা আর দেওয়া হয়নি। কয়েক বার তাগাদাতেও দেননি। শান্তাকুমারন শ্রীসন্ত সেই সময় থেকেই কাজ আর কথার মধ্যে সামঞ্জস্য হারিয়ে ফেলেছেন। কেরলের সাংবাদিকরা যে সেটা লক্ষ্য করেননি আশ্চর্য। নাকি লক্ষ্য করেছিলেন? শ্রীসন্তই তাঁদের আমল দেননি? তরুণ পারফর্মার বিগড়ে গেলে তার মধ্যে অবধারিত কিছু সঙ্কেত ভেসে ওঠে। কোনও কিছুতে মন বসাতে পারছে না। সারাক্ষণ অধৈর্য ভাব। আনমনা হয়ে কী যেন ভাবছে। কোনও একজনের সঙ্গে খুব বেশি সময় কাটাতে রাজি নয়। সব সময় যেন একটা উসখুস উসখুস ভাব। স্থিরতা বলে কিছু নেই। লাইফস্টাইলের চেকনাই দিন দিন বাড়ছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পেশার বাইরের বন্ধুদের সংখ্যা। শ্রীসন্তের মধ্যে সবক’টাই একে একে ফুটে উঠছিল।
দিল্লি পুলিশের হেফাজতে থাকা বিপথগামী পেস বোলারের কীর্তিকাহিনি শুনে এখন ফের মনে হচ্ছে কবি থেকে ফিক্সার— এ হেন অগৌরবজনক পর্যটন মোটেও এক দিনে হয়নি। কিন্তু এটা কি একা শ্রীসন্তের কাহিনি? নাকি শ্রীসন্তদের কাহিনি?
বিপথগামী একদল প্রতিভাবান যুবকের। যারা কেউ হয়তো কবিতা পড়ে। কেউ গান গায়। কেউ ছবি আঁকে। কেউ ক্রিকেট খেলে। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের মতো এদের পিছনে লেগে আজীবন সাসপেন্ড করে দেওয়াটা সহজতম রাস্তা। বরঞ্চ অনেক চ্যালেঞ্জিং হল, এদের রোগটাকে আক্রমণ করা। এদের রুগিটাকে নয়।
|
|
|
|
|
|