পারদ চড়ার মুখেই আচমকাই আঁচ পড়ে গেল পাহাড়ে।
পাহাড় জুড়ে বনধ ডেকেও শনিবার দুপুরে তা প্রত্যাহার করে নিয়ে মোর্চা ভরা পর্যটন মরসুমে ঈষৎ স্বস্তি ফিরিয়ে আনল।
তবে ভেঙেও মচকাচ্ছেন না মোর্চা নেতৃত্ব। শনিবার বুদ্ধ পূর্ণিমার জন্য ছাড় দিলেও আজ, রবিবার থেকে দার্জিলিঙের জেলাশাসক ও মহকুমাশাসকের অফিসের সামনে জিটিএ কাউন্সিলর এবং মোর্চার অন্য নেতারা অনশনে বসবেন বলে জানিয়েছেন। দাবি, গরুবাথানে তৃণমূল নেতার বাড়িতে আগুন লাগানোর ঘটনায় ধৃত মোর্চা নেতা চন্দ্র ইয়ংজনের মুক্তি। সেই সঙ্গে, বনধ প্রত্যাহার করা হলেও চার দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে রবিবার থেকে তাঁরা শুরু করছেন অনশন ও কর্মবিরতি। কর্মবিরতির তালিকা থেকে রেহাই মিলছে না জিটিএ কার্যালয়গুলিরও।
মোর্চার দাবি, ধৃতের মুক্তি ছাড়াও নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে চলা মামলা রাজ্য সরকারকে প্রত্যাহার করতে হবে। জিটিএ যাতে সুষ্ঠু ভাবে চলে রাজ্য সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে তা-ও। তরাই-ডুয়ার্সের ৩৯৮টি মৌজাকে জিটিএ-ভূক্ত করতে হবে বলেও দাবি জানিয়েছে মোর্চা নেতৃত্ব। |
তবে রাজনৈতিক মহলের অনুমান, বনধ প্রত্যাহারের মূল কারণ, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কড়া বার্তা’। শুক্রবার পাহাড় জুড়ে উত্তাপ ছড়ানোর মুখে মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন: “পাহাড়ে উন্নয়নের কাজকর্ম বনধ করার চেষ্টা বরদাস্ত করা হবে না। পাহাড়ে গণতান্ত্র, শান্তি বজায় রাখতে হবে। মোর্চা নেতাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে পাহাড়ের উন্নয়নের গতি আরও মসৃণ করতে হবে।” কথায় কথায় বনধের রাজনীতিতে রাজ্য সরকার যে আর নমনীয় হবে না সে বার্তা পেয়েই এ দিন বনধ প্রত্যাহার করে নেয় মোর্চা নেতৃত্ব বলে মনে করছেন রাজনীতির কারবারিরা।
তারউপর স্কুল-কলেজে গ্রীষ্মাবকাশ শুরু হয়ে যাওয়ায় পাহাড়ে এখন ভরা পর্যটন মরসুম। এই অবস্থায় বনধ ডাকা যে পাহাড়ের অর্থনীতির মেরুদণ্ডেই আঘাত করা তাও বুঝতে পারছিলেন মোর্চা নেতৃত্বের একাংশ। তাই দলেই এ নিয়ে চাপ তৈরি হচ্ছিল বলে মনে করছেন রাজনীতিজ্ঞরা।
মোর্চার সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরিও বলেন, “পাহাড়ে পর্যটন মরসুম চলছে। পরীক্ষাও রয়েছে। মাধ্যমিক-সহ নানা পরীক্ষার ফল প্রকাশ হতে চলেছে। ভর্তির ব্যাপারও আছে। সব দিক মাথায় রেখে আপাতত বনধ প্রত্যাহার করা হচ্ছে। তা বলে আমরা দাবি আদায়ের লক্ষ্য থেকে সরছি
না। সে জন্যই অনশন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।”
এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে রাজ্য সরকারও। সরকারি তরফে মোর্চাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, কোনও সমস্যা হলে তা আলোচনার মাধ্যমে মেটানোর উপরে জোর দিতে হবে। কথা-কথায় পাহাড় অচল করার চেষ্টা কোনও ভাবেই সরকার বরদাস্ত করবে না বলে মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট ভাষায় তাঁদের জানিয়ে দিয়েছেন।
উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব বলেন, “সব রাজনৈতিক দলেরই আন্দোলনের অধিকার রয়েছে। মোর্চাও করতে পারে। তা বলে অন্য কোনও দলের কর্মসূচিতে বাধা দিতে পারে না। এটা মোর্চা নেতাদের বুঝতে হবে। বিরোধী দলের প্রতি মোর্চা নেতাদের সহনশীল ভূমিকা নিতে হবে।”
এই প্রসঙ্গে সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য নিরুপম সেনের মন্তব্য, “মোর্চা এবং তৃণমূলের ফের সংঘাত শুরু হয়েছে। আক্রমণ প্রতি আক্রমণ চলছে। সুবিধেবাদী ঐক্য বেশিদিন স্থায়ী হয় না!”
তবে বনধ ডাকার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাহাড় জুড়ে পর্যটকদের মধ্যে সমতলে নেমে যাওয়ার হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। ম্যাল, চক বাজারের বাস স্ট্যান্ড সর্বত্র গাড়ির খোঁজ শুরু হয়ে যায়। শনিবার বিকেলের মধ্যেই দার্জিলিং পাহাড়ের তিন মহকুমার হোটেল ও অতিথি নিবাসের প্রায় অর্ধেকই ফাঁকা হয়ে যায় বলে ট্যুর অপারেটরদের সংগঠন সূত্রে জানা গিয়েছে। শিলিগুড়ির অন্যতম এক পর্যটন সংস্থার কর্তা সম্রাট সান্যাল বলেন, “পুজোর আগে এই সময়টাই সবচেয়ে বড় পর্যটন মরসুম। এখন পাহাড় অস্থির হলে গোটা দেশে অন্যরকম বার্তা যাবে।” পর্যটন মরসুমে আর্থিক লোকসানের আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন পাহাড়ের আম-জনতাও।
দার্জিলিং বেড়াতে এসেছিলেন সাহা ইন্সস্টিটিউট-এর কর্মী তরুণ তপন বিশ্বাস। তাঁর অভিজ্ঞতা, “ম্যালের কাছাকাছি হোটেলেই উঠেছিলাম। ভোরে হোটেলের অন্যান্য লোকজনের হইচইয়ে ঘুম ভেঙে গেল। পর্যটকদের অধিকাংশই হোটেল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। খোঁজ নিতে ম্যালে বেরিয়েই দেখি কী পরিস্থিতি! লোকজন কাকভোরে ব্যাগ, সুটকেস লটবহর নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন। যে যার মালপত্র গুছিয়ে ভোরেই হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছেন গাড়ি ধরতে।” বেলায় বনধ প্রত্যাহারে অবশ্য স্বস্তি ফিরেছে পাহাড়ে। সন্ধেয় ম্যাল ফিরেছে চেনা চেহারায়। |