এ এক অন্য বাস যাত্রা, যার গন্তব্য সংশোধনাগার।
এত দিন যাঁরা ছিলেন সংশোধনাগারের ছাত্র, এ বার তাঁরাই সংশোধকের ভূমিকায়। বাসে করে তাঁরা ঘুরবেন রাজ্যের বিভিন্ন সংশোধনাগারে। কারাজীবনে রং-তুলি হাতে কী ভাবে নিজেদের সংশোধন করেছেন, সেই পরিবর্তনের কাহিনি তাঁরা পৌঁছে দেবেন বন্দিদের কাছে।
অভিনব এই উদ্যোগ রাজ্য কারা দফতরের। ছবি আঁকা শিখিয়ে বন্দিদের সংশোধন করার কাজ শুরু হয়েছিল আলিপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে। সেটা ছিল ২০০৭ সালের ঘটনা। পরে, তা ছড়িয়ে গিয়েছিল রাজ্যের অন্যান্য কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে। বছর কয়েক ঘুরতেই দেখা যায়, ক্যানভাসে ঝড় তুলে এই কর্মসূচির অন্যতম মুখ হয়ে উঠেছেন সাট্টা ডন এবং বৌবাজার বিস্ফোরণ মামলার অন্যতম অভিযুক্ত রশিদ খানের মতো ভিভিআইপি বন্দিরা। রশিদ খান, হ্যাপি সিংহ, দিলীপ লেট, বাপি বাউড়ি, অ্যাঞ্জেলেস খালকো, সুপ্রিয় চট্টোপাধ্যায় রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে সাড়া জাগানো কিছু ঘটনার অপরাধীরা এখন সংশোধন প্রক্রিয়ার সামনের সারির সৈনিক বলে মনে করে কারা দফতর। গরাদের ও পারে এত দিন ওঁদের আঁকা শেখাতে উৎসাহ দিতে আসতেন বাইরের শিল্পীরা।
সময়ের হাত ধরে শিল্পী হয়ে ওঠা এই বন্দিরাই জেলা থেকে মহকুমার জেলবন্দিদের কাছে গিয়ে নিজেদের শুধরে ফেলার গল্প বলে উৎসাহিত করার চেষ্টা করবেন।
কারা দফতরের এক কর্তা জানিয়েছেন, এত দিন বাইরের শিল্পীরা জেলে গিয়ে বন্দিদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতেন। কিন্তু বন্দিদের দিয়ে অন্য কয়েদিদের উৎসাহ দেওয়ার এই প্রক্রিয়া নতুন। সম্ভবত, এ রকম একটা প্রচেষ্টা সারা দেশের মধ্যে এ রাজ্যেই প্রথম শুরু হচ্ছে।
রাজ্যের প্রাক্তন আইজি (কারা) বংশীধর শর্মাও বলছেন সে কথা। তাঁর মতে, “এটা খুবই উপযোগী ভাবনা। বন্দিদের জীবন এমনিতে নীরস।
সেই জীবনে যাঁরা রং আনতে পেরেছেন, তাঁরাই এ বার অন্যদের জীবনে রং আনবেন।”
অথচ এই সে দিনও হ্যাপি-বাপি-দিলীপদের অনেকেই তুলি ধরতে জানতেন না। জেলের এক কর্তা জানিয়েছেন, শিল্পীরা প্রথমে এসে ওই বন্দিদের বলতেন, যা খুশি আঁকো, যেমন খুশি আঁকো। পেন্সিল দিয়ে আঁকার পরে তাতে রং করতে বলা হত। রং আর আঁকা দেখে তাঁদের মানসিক অবস্থা যাচাই করা হত। এ ভাবেই ধীরে ধীরে তাঁদের জীবনে রং আনা হয়েছে। এখন আর ওঁদের বলতে হয় না। নিজেরাই মনের মাধুরী মিশিয়ে আঁকেন।
বাইরের প্রশিক্ষকদের দেখানো পথে এ ভাবেই এগিয়ে অন্যদের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন করতে চাইবেন রশিদ খানরা। ওই কর্তা বলেন, “যাঁরা আঁকা শিখেছেন তাঁরা বিভিন্ন জেলে গিয়ে কর্মশালা করবেন। অন্য বন্দিরা তাঁদের সঙ্গে যেমন খুশি আঁকবেন। আর একই সঙ্গে দেখবেন, কী ভাবে তাঁদের মতো বন্দিরাই শিল্পী হয়ে উঠেছেন। এটাই তাঁদের উদ্বুদ্ধ করবে ছবি আঁকতে।” কারা দফতর সূত্রের খবর, সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ৩০ মে এই বাসযাত্রা চালু করবেন রাজ্যের কারামন্ত্রী হায়দার আজিজ সফি। বিভিন্ন বন্দিকে বাসে করে নিয়ে যাওয়া হবে উত্তরবঙ্গে। আপাতত ঠিক হয়েছে, বহরমপুর, মালদহ, বালুরঘাট-সহ বিভিন্ন জেলে যাবেন ওই সব বন্দিরা। এ বার আর শুধু কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার নয়, জেলা থেকে সাব-জেলে যাবেন ওঁরা। বলবেন ফেলে আসা দিনের কথা। শোনাবেন, উত্তরণের কাহিনি। |